শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

উজাড় বনভূমি, ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ও

হুমকির মুখে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, টেকনাফ (কক্সবাজার) ও বান্দরবান ঘুরে

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভারে নুয়ে পড়েছে সমগ্র কক্সবাজার জেলা। এ পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সূত্রের তথ্য। এর ফলে প্রতিদিন উজাড় হচ্ছে এখানকার বনভূমি; ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়, গাছপালা ও লতাগুল্ম। হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে টেকনাফের সাবরাংয়ে সরকার অনুমোদিত এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন। যেভাবে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যত্রতত্র বসতি গড়ে তুলছে তাতে পর্যটননগর কক্সবাজারের সামগ্রিক পরিবেশও বিনষ্ট হবে বলে আশঙ্কা স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন মহলের। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যেন ক্ষতি না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে বলে তারা দাবি তোলেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী; টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, লেদা, মুছনী; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকডালা, তুমব্রু, জলপাইতলী, কলাবাগানসহ বিস্তৃত পাহাড় ও বনভূমির বাঁশ-গাছ উজাড় করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নিধন হচ্ছে পাহাড় ও পাহাড়ি খাসজমি হচ্ছে দখল। আগের থেকে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস থাকা সত্ত্বেও টেকনাফ, উখিয়ার বিস্তীর্ণ পাহাড়ে গত ২০ দিনে আশ্রয় নিয়েছে আরও ৫-৭ লাখ রোহিঙ্গা। এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আশ্রয় কেন্দ্র তথা বাঁশ-পলিথিন-ত্রিপলের তাঁবু তৈরিতে প্রতিদিন প্রয়োজন হচ্ছে লাখ লাখ বাঁশ ও গাছ। এই বাঁশ-গাছের জোগান দিতে গিয়েই উজাড় হচ্ছে পাহাড়ি বনভূমি, লতাগুল্ম। চড়া দামে বিক্রি করার সুযোগে একটি চক্র সরকার ঘোষিত অভয়ারণ্যের বাঁশ-গাছ কেটে ফেলছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এদিকে উখিয়ার বালুখালী ও থাইংখালীর পাহাড়ে সরকারের প্রস্তাবিত ২ হাজার একর জায়গায় নতুন করে আশ্রয়শিবির তৈরির কথা বলা হলেও এখানকার অধিকাংশ

পাহাড়ে রয়েছে সামাজিক বনায়ন। এ বনায়নের পেছনে স্থানীয়দের রয়েছে লাখ লাখ টাকার বিনিয়োগ। কিন্তু ইতিমধ্যে সরকার ঘোষিত এ পাহাড়গুলো চলে গেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দখলে। এর বাইরে আরও অন্তত ৫ হাজার একর জায়গায় অনিবন্ধিত অবস্থায় আশ্রয়শিবির গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। এতে সামাজিক বনায়নগুলো যেমন হুমকির মুখে পড়েছে, তেমনি ধ্বংস হচ্ছে এখানকার নানা প্রজাতির লতাগুল্ম ও জীববৈচিত্র্য। সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন কক্সবাজার জেলা সভাপতি প্রফেসর এম এ বারী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তা ঠিক। কিন্তু তাতে আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশের কথাও চিন্তা করা উচিত। কক্সবাজারের মতো একটি পর্যটন শহরের পাশেই লাখ লাখ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে এখন পুরো পর্যটনশিল্পই হুমকির মুখে। সেই সঙ্গে এখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশও বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ কক্সবাজার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার ২ হাজার একর পাহাড়ি ভূমিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির গড়ে তোলার অনুমতি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বালুখালী, কুতুপালং ও থাইংখালীর বনভূমিতে দেড় হাজার একর জায়গায় আশ্রয়শিবির করা হয়েছে। তার আগেই রোহিঙ্গারা আরও প্রায় ৫০০ একর বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে।’ কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘ইতিমধ্যে ৫ হাজার একরের বেশি বনভূমিতে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। এসব ভূমিতে রয়েছে সামাজিক বনায়নের গাছ। শুধু তাই নয়, বালুখালী বনভূমি হচ্ছে বন্যহাতির আবাসস্থল, পশুপাখির অভয়ারণ্য। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিনই কাটা হচ্ছে লাখ লাখ বাঁশ, গাছ, লতাগুল্ম। ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য।’ কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর অধিকাংশেই পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার সিংহভাগই খোলা পায়খানা ব্যবহার করছে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা খোলা আকাশের নিচেই মলমূত্র ত্যাগ করছে। এতে এখানকার স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হতে শুরু করেছে। শিগগিরই পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে স্থানীয় জনগণ।

সর্বশেষ খবর