রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এবার পাকিস্তানি কোম্পানিকে জিএসএ দিচ্ছে বিমান

আছে জালিয়াতি অযোগ্যতার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্যাবিনেট বৈঠকে বিমানের দুর্নীতি ও অরাজকতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী চরম অসন্তোষ প্রকাশ করলেও টনক নড়ছে না কারোরই। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রীর এমন সতর্কবার্তার পর আবারও বড় ধরনের কেলেঙ্কারিতে জড়াচ্ছে বিমান। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এবার পাকিস্তানি কোম্পানিকে জিএসএ (জেনারেল সেলস এজেন্ট) দেওয়ার সব আয়োজন চূড়ান্ত করেছে তারা। বিতর্কিত ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে কাগজপত্র জালিয়াতি, অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও জঙ্গি অর্থায়নের মতো অভিযোগ থাকার পরও একটি প্রভাবশালী মহল এখন আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে। অথচ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আপত্তি থাকার পরও মামাস নামের ওই কোম্পানিকে দ্রুত কাজ দেওয়ার জন্য আগামী মঙ্গলবারের পর্ষদ সভার এজেন্ডাভুক্ত করা হয়েছে। ওই বৈঠকেই মামাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন একজন পর্ষদ সদস্য। এতে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে খোদ বিমানের শীর্ষ মহলে। জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননও বিমানের ওপর কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘মামাসকে কাজ দেওয়ার পক্ষে নই। এটা তো হওয়ার কথা নয়।’ জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরবে বাংলাদেশ বিমানের তিনটি স্টেশনের জিএসএ হিসেবে পাকিস্তানি একটি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার তদবির চলছে। শক্তিশালী চক্রের জোরে ইতিমধ্যে এ বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত করে ফেলা হয়েছে। অথচ খোদ বিমানের দায়িত্বশীলরাই অভিযোগ করছেন, মামাসের কাগজপত্র ঠিক নেই। মামাস এভিয়েশনের পক্ষে জিএসএর জন্য আবেদন করা হলেও কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে আল মোসাইদ নামে অন্য এক কোম্পানির নামে, যা বড় ধরনের জালিয়াতি ও ছলচাতুরী বলে বিমানের পক্ষ থেকে মামাসের কাছে কিছু আপত্তি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেই আপত্তির জবাবে মামাস যেসব ব্যাখ্যা দিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য ও সন্তোষজনক নয় বলে স্বীকার করেছেন বিমানের একাধিক কর্মকর্তা। তাদের ভাষ্যমতে, এত বড় জালিয়াতি করার মাধ্যমে যদি মামাস কাজ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়, তাহলে এ নিয়ে চরম খেসারত দিতে হবে বিমানকে। এমনিতেই বিমানের টিকিট কেনাবেচা নিয়ে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের দরুন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। এটা জেনেও বিমান ও মন্ত্রণালয়ের একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এ তদবির করছে। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এদের অন্যতম বিমানের একজন জিএম ও জিএসএ-সংক্রান্ত বোর্ড সাব-কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য, যিনি প্রকাশ্যেই মামাসের পক্ষ নিয়ে প্রভাব সৃষ্টি করছেন। ইতিমধ্যে রিয়াদ থেকে সায়মন নামের এক ব্যক্তি ঢাকায় এসে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে প্রকাশ্যে তদবিরে নেমে বিষয়টি পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন বলেও বিমানের একজন পরিচালক জানিয়েছেন। ওই পরিচালক জানান, সম্প্রতি বিমানের এক পর্ষদ সভায় মামাস এভিয়েশন নামে এ কোম্পানিকে সৌদি আরবের জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মাম স্টেশনে জিএসএ নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিমান পরিচালনা পর্ষদ গঠিত বোর্ড সাব-কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী। এরপর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে মামাসকে জিএসএ হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এ বিষয়ে বিমানের এক পর্ষদ সদস্য জানান, পাকিস্তানি নাগরিকের মালিকানাধীন জিএসএ কোম্পানিকে একসঙ্গে সৌদি আরবের তিন স্টেশনে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। এ অবস্থায় মামাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্তে মামাসের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর পরই বিমান কর্তৃপক্ষ মামাসকে কার্যাদেশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সম্প্রতি রহস্যজনকভাবে মন্ত্রণালয়ের এই তদন্ত রিপোর্ট পাশ কাটিয়ে একটি সিন্ডিকেট আবারও মামাসকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য জোর তদবির শুরু করেছে।

বিমানসূত্র জানায়, মামাস নামে যে কোম্পানিকে বিমান জিএসএ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ওই কোম্পানির মালিক একজন পাকিস্তানি। এ ছাড়া বিমানের সবচেয়ে বড় স্টেশন জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মাম পরিচালনা করার মতো অভিজ্ঞতাও নেই মামাসের। জেদ্দায় তাদের কোনো নিজস্ব অফিস নেই। নামসর্বস্ব একটি অফিস থাকলেও সেখানে বাংলাদেশি কোনো স্টাফ নেই। একমাত্র ইন্দোনেশিয়ার একটি ছোট এয়ারলাইনসের জিএসএ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাদের। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, মামাস এভিয়েশন দরপত্রে যেসব কাগজপত্র দাখিল করেছে তা আল মোসাইদ নামের অন্য একটি কোম্পানির, যা দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জিএসএ হতে হলে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) সদস্য হতে হয়। কিন্তু মামাস এখনো আইএটিএর সদস্য হতে পারেনি। এ অবস্থায় তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশে মামাসকে সৌদি আরবে বিমানের তিনটি বড় স্টেশনের জিএসএ হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ার সুপারিশ করে রিপোর্ট দেয়। এ ছাড়া একটি কোম্পানিকে একসঙ্গে তিনটি বড় স্টেশনের জিএসএ নিয়োগ দেওয়ার রেকর্ডও বিমানের ইতিহাসে নেই। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ মামাসকে নিয়োগের বিষয়টি স্থগিত করে দেয়। এরপর তিন স্টেশনে কর্মরত বর্তমান জিএসএর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের চুক্তির মেয়াদ আরও তিন মাস বর্ধিত করা হয়। বর্তমানে জেদ্দা স্টেশনে জিএসএ হিসেবে কাজ করছে এলাফ এভিয়েশন আর রিয়াদ ও দাম্মাম স্টেশনে এসিই নামে একটি কোম্পানি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, মামাস বিমানের স্টাফদের পক্ষে জরুরি মুহূর্তে সৌদি আরবের ভিসা করিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ধরনের যোগ্যতা নেই। এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে রিয়াদের মতো সবচেয়ে একটি লাভজনক স্টেশনের জিএসএ দেওয়া হলে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন একাধিক বিমান কর্মকর্তা। অভিযোগ আছে, বিমানের একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট নানা কৌশলে বিমানের বিভিন্ন স্টেশনে তাদের পছন্দের জিএসএ নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চালায়। এ চক্রটিই মামাসকে আবারও ওই তিন স্টেশনের জিএসএ নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিমান মন্ত্রণালয়ে তদবির শুরু করেছে।

সর্বশেষ খবর