শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

চার সংকটে বেহাল চালের বাজার

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ
কোনো কারণ ছাড়াই দাম বাড়ছে হু হু করে

সাঈদুর রহমান রিমন

চার সংকটে বেহাল চালের বাজার

দেশে চালের মজুদ বাড়াতে তিন মাস ধরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়াতে আমদানির ওপর শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ করা হয়েছে। বাকিতে ঋণপত্র খোলার সুযোগ পেয়েছেন আমদানিকারকরা। অবৈধ মজুদ ঠেকাতে ১৬ শতাধিক চালকল মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। চাল আমদানিতেও মনোযোগ দিয়েছে সরকার। এত কিছুর পরও চালের বাজারে অস্থিরতা কমছে না। বরং দিন দিন চালের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অবস্থা এমন যে, সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে চালের দাম। এদিকে ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিচ্ছে এমন খবরে দেশের চালের বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। নয় দিনের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা করে বেড়েছে। ভালো মানের চালের কেজি ৭২ টাকায় ঠেকেছে। সাধারণ মোটা চালও ৫৫ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। এক সপ্তাহ আগেই বাজারে এই চাল বিক্রি হতো ৪৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হতো ৫৫ টাকা কেজি দরে। এখন সে চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭২ টাকার ওপরে। গত কয়েক দিনে কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ছে দাম। এমন পরিস্থিতিতে চাল নিয়ে দেশের মানুষ ভীষণ বিপাকে আছে। এ পরিস্থিতিতেও শিগগির চালের দাম কমার কোনো আশা দেখছেন না ব্যবসায়ীরা। উল্টো দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। অন্যদিকে আড়তদারদের অভিযোগ, বাড়তি দাম দিয়েও মিলারদের কাছে চাল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দামের অস্থিরতা দেখে নিজে থেকেই চাল কেনা বন্ধ রেখেছেন অনেক আড়তদার। তবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, ‘অসৎ মিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবৈধ মজুদকৃত চালও শিগগিরই বাজারে চলে আসবে। চালের সরবরাহ স্বাভাবিক হলেই দামও কমবে।’ এদিকে বাংলাদেশে চালের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে ইতিমধ্যে সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সংস্থাটির মতে, গত তিন মাসে দেশে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এবারই প্রথম বাংলাদেশের জন্য এমন সতর্কবার্তা দিল এফএও। এ অবস্থার মধ্যেও চালের সংকট নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে সরকারের সকল পর্যায় থেকে। খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে চালের সংকট নেই। জাতীয় সংসদে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কারা এসব গুজব ছড়িয়ে খেলছে?’ কোথাও কেউ মজুদ রেখে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে কি না তল্লাশি করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও ঘোষণা দেন তিনি।

চাল সংকটের যত কারণ : বন্যার অজুহাতে চালের মজুদদারি, অজ্ঞাত স্থানে পাচার, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিসহ দেশজুড়ে মহাসংকট তৈরির পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশে দিনে ৮৫ হাজার টন চাল লাগে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘গত চার মাসে আমরা ১ কোটি ২ লাখ টন চাল খেয়েছি। আরও ১ কোটি টন চাল দেশে আছে। হয় মিলমালিক, আড়তদার, না হয় ছোট-বড় ব্যবসায়ী— কারও না কারও বাড়িতে এসব চাল আছে। এর পরও চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে।’ কিন্তু বাজার বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, চার কারণে চালের সংকটসহ বাজারজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে— পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা, মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহে ব্যর্থতা, সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া, দেরিতে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত। এ চার সংকটের অন্তত তিনটির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ তোলা হচ্ছে। যথাসময়ে চাল আমদানি না হওয়া প্রসঙ্গে বাবুবাজার-বাদামতলী চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই চাল আমদানির সুযোগ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। সরকার তখন চাল আমদানির অনুমতি দেয়নি।’ কারণ ব্যাখ্যা করে নিজামউদ্দিন বলেন, ‘যখন শুল্ক কমানো হলো তখন ভারত চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে শুল্ক কমানোর পরও বেশি দামে চাল আমদানি করে ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারেননি।’ অন্যদিকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল সংগ্রহের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ের মজুদদাররা কারসাজি করেই সরকারকে ধান-চাল কিনতে দেননি। ইতিমধ্যে সরকারকে ধান-চাল কিনতে না দেওয়া এবং অবৈধ মজুদের অভিযোগে ১৬০০ ডিলারকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথাও জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয় আমদানির ক্ষেত্রেও তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। চাল আমদানি করতে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, রাশিয়া, ভিয়েতনাম ও ভারত এই পাঁচ দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বাংলাদেশ। এর মধ্যে একমাত্র ভিয়েতনাম তাত্ক্ষণিকভাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ভিয়েতনাম সরকার চুক্তির আড়াই লাখ টন চালের মধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। অন্যদিকে চাল ও গম কিনতে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশে সফর করেছেন খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে থাকা বাংলাদেশ এখন চাল নিয়েই গভীর সংকটে পড়েছে।

চালকল মালিকদের কারসাজি : দেশে চালের দাম দফায় দফায় বাড়ার পেছনে যে চালকল মালিকদের কারসাজি রয়েছে এর প্রমাণ মিলল মিনিকেট চালের সর্ববৃহৎ মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে। অতিসম্প্রতি এ চালের মোকামে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে কারসাজির সত্যতা মিলেছে। ওই অভিযানে চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুর রশীদের চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করেছে টাস্কফোর্স। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে টাস্কফোর্স এ অভিযান চালায়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, কুষ্টিয়াসহ উত্তরাঞ্চলের ৭০ জন বড় চালকল মালিকের কাছে প্রায় ২৫ লাখ টন ধান মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুর রশীদের গুদামেই ২ লাখ টন ধান মজুদ আছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানান। খোদ বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি রশীদের মিলের ১৩টি গুদামে গিয়ে ধান-চালের মজুদচিত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন টাস্কফোর্সের কর্মকর্তারা। টাস্কফোর্সের প্রধান সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কিছু মিলমালিক কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। তারাই বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সিন্ডিকেটবাজির মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন বিপুল অর্থ।’ এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘চালের বাজার অস্থিতিশীলকারী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে চালের অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর