বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

হুমকির মুখে হাতিসহ ২০ হাজার বন্যপ্রাণী

পাহাড়ে রোহিঙ্গা

মোস্তফা কাজল, কক্সবাজার থেকে ফিরে

নতুন করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের বসতি স্থাপনে কক্সবাজারসহ পাশের দুই জেলার বনভূমি হুমকির মুখে পড়েছে। প্রতিদিনই পাহাড় ও বনের গাছপালা কেটে নতুন বসতি তৈরি হচ্ছে। এতে এসব এলাকার হাতিসহ প্রায় ২০ হাজার বন্যপ্রাণীর জীবনও ঝুঁকিতে পড়েছে। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি— এ তিন জেলায় বনভূমির পরিমাণ ৯০ হাজার ৮৭০ একর। এর মধ্যে হিমছড়ি ও টেকনাফে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এবং ফরেস্ট বন বিটে রোহিঙ্গাদের আনাগোনা ও বাসভূমি তৈরিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এসব এলাকার টিলা ও পাহাড় কেটে ন্যাড়া করা হয়েছে। তিন জেলার মধ্যে কক্সবাজারে ৯ হাজার, বান্দরবানে ৬ হাজার ও রাঙামাটির বিভিন্ন বন ও পাহাড়ে ৫ হাজার বন্যপ্রাণী আছে। বন বিভাগ জানায়, প্রাথমিক হিসাবে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে নতুন নতুন বসতি তৈরির জন্য তিন জেলার ছোট-বড় মিলিয়ে দেড় লাখ গাছ কাটা হয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এভাবে বন বিভাগের গাছ কেটে ফেলার কারণে কমপক্ষে ২০ হাজার বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল এখন বিপন্ন হওয়ার পথে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে এ বনের পাহারাদার নামে পরিচিত হাতি, উল্লুক ও চিতা বাঘ। তথ্যমতে, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বনে দেড় শতাধিক হাতি রয়েছে। অনেকে বলছেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বাংলাদেশ থেকে হাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে ওই তিন জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন জাতের সাপের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব সাপের মধ্যে অজগর, গোখরা, দুধরাজ ও কালনাগিনী অন্যতম। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাঈনউদিন বন বিভাগের হাজার হাজার একর ভূমিতে রোহিঙ্গা বসতি তৈরি হয়েছে নিশ্চিত করে বলেন, বন বিভাগের ক্ষতি কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উখিয়ায় ২ হাজার একর জমিতে শরণার্থী ক্যাম্প করা হচ্ছে। এ তিন জেলার বন থেকে প্রতি বছর কাঠ নিলামের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আয় হয় সরকারের। এ বছর আয় থেকে বঞ্চিত হতে হবে সরকারকে। সরেজমিনে এ তিন জেলা ঘুরে দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা বনের মূল্যবান কাঠ-বাঁশ কেটে প্রতিদিন মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিচ্ছে। আবার অনেকে আগে থেকে আসা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। তবে কক্সবাজারসহ তিন জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি জনপদে রোহিঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার মনাইপাড়া, গোদারপাড়, ডাক্তারছোলা, ডাইলংপাড়া, চৌধুরীপাড়া, নাকাটা, তলতলা, দোচালা, ডিলাইট, চিকনছড়া, কচুপাড়া এলাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসতি গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। এ ছাড়া রাউজান উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের বৃন্দাবনপুর, ওয়াহেদ্যাখীল, বানারস, জানিপাথর, গলাচিপা, হলদিয়া রাবারবাগান, এয়াসিননগর জাইল্যা টিল্যা, আফজইল্যার টিলা, ডাবুয়া ইউনিয়নের মেলুয়া, রাধামাধবপুর, ডাবুয়া রাবারবাগান, হিংগলা, মেলুয়া, রাউজান পৌর এলাকার রাউজান রাবারবাগান, পূর্ব রাউজান কাজীপাড়া, পূর্ব রাউজান, ঢালার মুখ, দাওয়াতখোলা, হরিণকাটা, পাউন্ন্যা, ৭ নম্বর রাউজান ইউনিয়নের পূর্ব রাউজান, মুখছড়ি, ভোমরঢালা, কদলপুর ইউনিয়নের শমশেরপাড়া, ভোমরপাড়া, কমলার টিলা, ইসলামিয়া নতুনপাড়া. জয়নগর বড়ুয়াপাড়া ও পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তরপাড়া পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়েছে রোহিঙ্গারা। সবচেয়ে বেশি বসতি গড়ে তুলছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। এ ছাড়া উপজেলার কোদালা, নারিশ্চা, হোচনাবাদ, চন্দ্রঘোনা বনগ্রাম, রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ইছাখালী, ইসলামপুর, রাজানগর, পোমরা, বেতাগি ও সরফভাটাসহ হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে। কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মিলন পালিত বলেন, বেতবুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় কয়েক শ রোহিঙ্গা পরিবার বসতি গড়ে তুলেছে। রাউজানের কয়েকটি ইউনিয়নের গহিন পাহাড়েও রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তোলার খবর বন বিভাগ জানতে পেরেছে। টেকনাফ উপজেলার কুতুপালং ইউনিয়নের খাজার টিলার পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়ে তোলা রোহিঙ্গা পরিবারের বুদ্ধা সুরা খাতুন বলেন, ‘প্রাণ বাঁচাতে নিকটাত্মীয়সহ আরও চার পরিবারকে নিয়ে ১০ দিন আগে এখানে এসেছি। এখন বনের কাঠ-বাঁশ আর শণ দিয়ে কোনোরকমে ঘর বানিয়ে থাকছি। চার দিন আগে এ ইউনিয়নের পাহাড়ে একসঙ্গে বসতি গড়েছে অর্ধশত পরিবার। বনের বাঁশ-কাঠ-শণ কেটে ও জঙ্গল পরিষ্কার করেই তারা বসবাস শুরু করছে।

সর্বশেষ খবর