মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ মত

বজ্রপাতে কেন এত মৃত্যু

জলবায়ু পরিবর্তন মোবাইলসহ মেটালের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া • রক্ষা পেতে লম্বা গাছ লাগাতে হবে

নিজামুল হক বিপুল

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ, তাল গাছের মতো লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, মোবাইল ফোনের ব্যবহার, যত্রতত্র মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসানো, কলকারখানা ও মোটরগাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কৃষি কাজে ভারী যন্ত্রের ব্যবহারসহ নানা কারণে বজ পাতের হার বেড়ে গেছে।  গত কয়েক বছরে দেশে বজ পাত ও প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে এসব কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অতিরিক্ত শকড বা ধাক্কার কারণে মানুষ হার্ট অ্যাটাক করে এবং মারা যায়। বজ পাত থেকে রক্ষা পেতে হলে তাল গাছের পাশাপাশি লম্বা হয় এমন গাছও লাগাতে হবে। লম্বা গাছ থাকলে বজ পাতের আঘাত থেকে বাঁচা যাবে।

গত কয়েক বছরে দেশে বজ পাতের সংখ্যা ও এতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে। এবারের বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই দেশে বজ পাতের সংখ্যা অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বজ পাতে মৃত্যুর হারও বেড়েছে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায়। এমনকি বর্ষা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বজ পাতের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ গত শনিবার দেশের তিন জেলায় বজ পাতে মারা গেছেন ১১ জন। যা খুবই অস্বাভাবিক।

কিন্তু কেন বজ পাতে মানুষ মারা যায় এবং দিন দিন মৃত্যুর হার বাড়ছে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে বেশ কিছু তথ্য। বজ পাত নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন এমন বিশেষজ্ঞরা উল্লিখিত কারণগুলো চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, বজ পাত সারা বছরই কমবেশি হয়। তবে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বজ পাতের হার বেড়ে যায়। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাঁচটি এলাকা সবচেয়ে বেশি বজ পাতপ্রবণ। এগুলো হচ্ছে-শ্রীমঙ্গল, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর এবং সৈয়দপুর। এই পাঁচটি এলাকায় বছরে গড়ে ৩২৪, ৩২৪, ২০৬, ১৯৫ এবং ১৭৯টি বজ পাত ঘটে। আর রাজধানীতে গড়ে বছরে বজ পাত ঘটে ১২৪টি। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বজ পাত হয় মে মাসে। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, আশির দশকে মে মাসে যেখানে গড়ে ৯ দিন বজ পাত হতো, এখন সেখানে এই হার কয়েকগুণ বেশি। তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সারা দেশে পাঁচ হাজার ৭৭২টি বজ পাত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে ৯৭৮টি, ২০১২ সালে ১২১০টি, ২০১৩ সালে ১৪১৫টি, ২০১৪ সালে ৯৫১টি ও ২০১৫ সালে ১২১৮টি। আর ২০০০ সাল হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১৫১ দিনে ৪৬৮টি বজ পাত হয়েছে। আর ১৯৮৫ সাল হতে ১৯৯৯ পর্যন্ত গড়ে ১৪৫ দিনে বজ পাতের ঘটনা ঘটেছে ৪৩৯টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদ্যুৎ প্রবাহ মানুষের শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে মানুষ যেভাবে সঙ্গে সঙ্গে শকড হয়, ঠিক একইভাবে বজ পাতেও মানুষ শকড হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। তিনি বলেন, ইদানীং মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বা ঘন কালো মেঘের ওপরে ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে প্রবাহিত হয়। এ কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে বজ পাতের সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়েছে। তিনি বলেন, মানুষ খোলা আকাশের নিচে যখন কাজ করে, বিশেষ করে কৃষি কাজে যখন থাকে তখন বজ পাত থেকে রক্ষা পাওয়া বেশ কঠিন। তবে একটু সতর্ক হলেই নিজেকে রক্ষা করা যাবে। এক্ষেত্রে আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যেতে হবে। তাহলেই বজ পাতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, হাওর ও উন্মুক্ত এলাকায় বড় গাছ তো দূরের কথা, কোনো গাছপালাই থাকে না। ফলে এমন এলাকায় মানুষের চুলই সতর্কবার্তা দিতে পারে। বজ পাতের আগে মানুষের মাথার চুল খাঁড়া হয়ে যায়। এটা একটা সতর্কবার্তা। তখনই দ্রুত সাবধান হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপক আবদুস সামাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শকড মানে প্রচণ্ড ধাক্কা। হঠাৎ ধাক্কার কারণে মানুষ হার্ট অ্যাটাক করে। শরীরের অনেক অংশ অকার্যকর হয়ে যায়। এ কারণেই মানুষ মারা যায়। বজ পাত হচ্ছে সেরকম একটি শকড। এ কারণেই মানুষ বজ পাতে মারা যায়। তিনি বলেন, বজ পাত যেখানে ঘটে তার আশপাশে লম্বা গাছ বা যে বস্তু থাকে সাধারণত সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লম্বা গাছ বা লম্বা বস্তুর পাশে খাটো কিছু থাকলে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তিনি বলেন, তাল গাছের মতো লম্বা গাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বজ পাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ পাত বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বেড়েছে, কম্পিউটারের ব্যবহার বেড়েছে। কৃষি কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে। বৈদ্যুতিক টাওয়ারের সংখ্যা বেড়েছে। এসব কারণে বজ পাতের হারও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, সতর্কতার জন্য বিরূপ আবহাওয়ার সময় ঘরের ওয়াইফাই সংযোগ, ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, মোবাইল, কম্পিউটার এগুলো বন্ধ রাখতে হবে। বজ পাতের সময় একসঙ্গে অনেক লোক জড়ো হওয়া যাবে না। বিশেষ করে উন্মুক্ত স্থানে একসঙ্গে অনেক লোক একত্রিত হলে মৃত্যুর হার বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গাছের সংখ্যা কমে গেছে। বিশেষ করে লম্বা গাছের সংখ্যা খুবই কম। তাই বজ পাত থেকে রক্ষা পেতে হলে তাল গাছের পাশাপাশি লম্বা হয় এমন গাছও লাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে লম্বা গাছ থাকলে বজ পাতে মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর