বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ৩

বন সাবাড় করছে রুমন-আনসার গ্রুপ

দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, শ্রীমঙ্গল

বন সাবাড় করছে রুমন-আনসার গ্রুপ

দেশের বিখ্যাত বনগুলোর অন্যতম লাউয়াছড়া বন। এটি একটি সংরক্ষিত বন। সুন্দরবনের পরই এর অবস্থান। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকার এখানে বৃক্ষায়ন করলে তা বেড়ে আজকের এই বনের সৃষ্টি হয়। এ বনের সার্বিক দেখভাল করেন বনরক্ষীরা। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবল ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে তাদের অবস্থাও নাজুক। আর এ সুযোগে বনদস্যুরা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আক্রমণ করে বন থেকে গাছ কেটে নিয়ে যায়। ৬ আগস্ট সহকারী বন সংরক্ষকের কার্যালয় থেকে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে ফুটে ওঠে বনের বর্তমান চিত্র। বর্তমানে লাউয়াছড়া বনের গাছ চুরির সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে রুমন-আনসার গ্রুপ। তারাই এখন ওই এলাকার চিহ্নিত গাছ চোর চক্র। তাদের বিরুদ্ধে কমলগঞ্জ থানা ও আদালতে একাধিক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ এলাকায় একজন প্রভাবশালী আগর গাছ চোর রয়েছে। বনের যত আগর গাছ চুরি হয়েছে সবই তার মাধ্যমে। বনকর্মীরা গাছ চোর শহীদ, জুনাইদ ও বাসিদকে ধরতে পারলেও তাদের দলনেতাকে এখনো ধরতে পারেননি। এ ছাড়া চিহ্নিত গাছ চোর সুরমান, হুরুদ, আহম্মদ, রুমন ও আনসারের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। তবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সেগুন, গামাই, লোহাকাঠ ও আগর গাছ চুরির সঙ্গে আরও অনেক সিন্ডিকেট জড়িত ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। বন বিভাগের হিসাবমতে, গাছ চোর চক্র চার মাসে লাউয়াছড়া বনের চারটি সেগুন ও তিনটি আগর গাছ কেটে নিয়েছে। ৭ জুলাই রাতে গাছ চোর চক্র একটি আগর গাছ কাটার সময় দুজন সিপিজি সদস্য ছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এ ছাড়া জাতীয় উদ্যান রক্ষায় সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিও খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা শুধু মাসিক সভাগুলোয় উপস্থিত থাকেন। অনেক সিপিজি সদস্যকেও রাতের বেলায় পাওয়া যায় না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ভানুগাছের সংরক্ষিত বনের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকা ১৯৯৬ সালে সরকার জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর ২০০৫ সালে এ উদ্যানের বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বন বিভাগের সঙ্গে নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প কাজ শুরু করে। নিসর্গ বন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে। এ ছাড়া বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের বিকল্প জীবিকায়নের জন্য এলাকার চিহ্নিত গাছ চোরদের নিয়ে বন রক্ষায় কমিউনিটি পেট্রল গ্রুপ (সিপিজি) গঠন করা হয়। ওই টহল দলে রয়েছেন ৪৭ পুরুষ ও ১৮ জন মহিলা। একজন পুরুষ মাসে ১০ দিন বনকর্মীদের সঙ্গে ক্যাম্পে ডিউটি করেন। আর এজন্য তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় প্রতি রাতে ১০০ টাকা। গাছ চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ২০১২ সালে সিপিজি সদস্য আহাদ আলী, আইয়ুব আলী, বাবুল ও জুনাব আলীকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। সিপিজি টহল দলের সাবেক সভাপতি আহাদ আলী বলেন, ‘বনদস্যুদের বন পাহারার দায়িত্ব দেওয়ায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক সিপিজি সদস্য বলেন, ‘মাসে ১ হাজার টাকায় কি কেউ চলতে পারে। এ ছাড়া অনেক সিপিজি সদস্যের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। তারা মামলার তারিখের আগের রাতে গাছ কেটে ফেলেন। গাছ বিক্রির টাকা দিয়ে পরদিন মামলার খরচ চালান।’ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে রয়েছে গর্জন, সেগুন, গামারি, মেনজিয়াাম, জামরুল, চাপালিশ, নাগেশ্বর, শিমুল, লোহাকাঠ, জাম, ডুমুর, তুন, কড়ইসহ নানা প্রকারের গাছ। রয়েছে নানা ধরনের অর্কিড। দীর্ঘ সময় ধরে বনদস্যুদের থাবায় লাউয়াছড়া বন এখন বিরান ভূমি। বনের প্রবেশপথে সারিবদ্ধ কিছু গাছ দেখা গেলেও বনের গহিনে গেলে দেখা যায় শুধু গাছের গোড়া। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অনেক সিপিজি সদস্য গাছ চুরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রায়ই বনকর্তাদের মোবাইলে সিপিজি সদস্য বাক্কু, সেলিম, সুফি ও শাহানুরের নামে গাছ চুরির সংবাদ আসে। লাউয়াছড়া বনের তথ্য সংগ্রহে করতে গিয়ে সাংবাদিকদেরও অনেক সিপিজি সদস্যের বাধার মুখে পড়তে হয়। বন বিভাগের রেকর্ড অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার গাছ কেটে নিয়েছে চোরের দল। এর বিপরীতে মামলা হয়েছে ৬২৩টি। লাউয়াছড়া বিট কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রাত জেগে বন পাহারা দিই আর আল্লাহকে ডাকি সকালে গাছ কাটার কোনো সংবাদ যেন না আসে।’ শ্রীমঙ্গল প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম ইদ্রিস আলী বলেন, ‘বনদস্যুদের দিয়ে কোথাও বন পাহারা দেওয়া হয় আমার জানা নেই। যত দ্রুত সম্ভব সরকারি বনপ্রহরীর সংখ্যা বাড়াতে হবে।’ বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো বলেন, ‘সিপিজি সদস্যরা বনের গাছ চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর