বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিষ্ঠুরতায় নির্বাক সাগরের পরিবার

গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

নিষ্ঠুরতায় নির্বাক সাগরের পরিবার

বস্তির যে ছোট্ট খুপরি ঘরটিতে সাগর ও তার পরিবার থাকত, সেখানেই দেখা মেলে নিহত সাগরের মা হাসি বেগমের। শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। চৌকির ওপর নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে ছিলেন বাবা শিপন মিয়া। তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। পাশের একটি ঘরে গিয়ে দেখা মেলে সাগরের সবচেয়ে ছোট বোন অনিকার। নিষ্পাপ এই শিশুটি এখনো বুঝে উঠতে পারছে না তার প্রিয় ভাইটি আর নেই। পরিবারের অন্য সদস্যরা আর বস্তিবাসী তখন ব্যস্ত মর্গ থেকে সাগরের লাশ আনা নিয়ে। গতকাল সকালে ময়মনসিংহ নগরীর স্টেশন ঘেঁষে গড়ে ওঠা মালগুদাম বস্তিতে গিয়ে দেখা যায় এমন শোকাবহ দৃশ্য।

নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতায় নির্বাক সাগরের পরিবার। শিশু সাগরের এমন বিদায় মেনে নিতে পারছে না কেউ। আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, এলাকাবাসী সবাই শোকে মুহ্যমান। কারও কারও বুক চিরে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। গোটা বস্তিতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

দুপুর দেড়টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে নিয়ে আসা হয় সাগরের লাশ। দেখা মেলে ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহের। এ সময় দেখতে আসা সবার দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। বাদ আসর মালগুদাম মসজিদে জানাজা শেষে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ভাটিকাশর পৌর গোরস্থানে। সেখানেই সাগরকে চিরতরে বিদায় দেন পরিবার ও তাদের সতীর্থরা।

জানতে চাইলে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে এজাহারভুক্ত আসামি রিয়াজ উদ্দিনকে (৫০) গৌরপুরের শ্রীরামপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল তাকে ১৪৪ ধারায় জবানবন্দির জন্য আদালতে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি সেখান থেকে বাকি আসামিদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে।’ তিনি বলেন, এর আগে সাগরের বাবা শিপন মিয়া গৌরীপুর থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। গতকাল বেলা ১১টার দিকে সাগরদের ঘরটিতে একটু উঁকি দিয়ে দেখা যায় মা হাসি বসে আছেন ভাতের থালা নিয়ে। কিন্তু ক্ষুধা থাকলেও মুখে তুলতে পারেননি আলুভর্তা মাখানো ভাতগুলো। এ সময় সাংবাদিক দেখেই তিনি বলেন, ‘আফনেরা এই মাইরের বিচার কইরা দেইন। দেশে আইন আছিল। অপরাধ যদি কইরাই থাকত একটা পাউ কাইট্টা রাইখখা দিত। তাও তো আমার পোলাডারে পাইতাম!’ খানিক পরই বিলাপ করতে করতে বুক চাপড়ে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই চাই না। আমার সাগররে আফনেরা আইন্যা দেইন। সুস্থ শরীরডা নিয়া গেছিল। আইলো লাশ অইয়া। আমার কোনো বিচারক নাই। এই বিচার উপরওয়ালাই করব।’ বোঝা গেল এখন তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন ছেলেকে পিটিয়ে হত্যার নির্মমতার স্মৃতিচিহ্ন। এই মায়ের চোখগুলো এখন লোনা বৃষ্টিতে ভেজা। যে মুখের ক্যানভাসে আঁকা হয়েছিল সন্তানের জন্য রাজ্যের শুভকামনা, সেই মুখটিই এখন রক্তহীন শুকনো কলাপাতার মতো। আর বুকের ভিতরে সন্তানের স্মৃতিচিহ্ন পোড়াচ্ছে মমতাময়ী এই মাকে। ঘরটির বাইরেই রেললাইনের ওপর আশপাশের ঘরগুলোর লোকজনের ভিড়।

সেখানে ফাতেমা আক্তার মনা নামের একজন বলছিলেন, ‘ফিশারির মালিক মারার সময় কইছে, এরুম টুকাই পাঁচ-ছয়ডা মাইরালাইলে কিছুই অইত না। লাগলে এক কাডা জাগা বেইচ্চা মামলা শেষ কইরা দেম।’ পরে জানা গেল সাগরকে ছোট থেকেই লালন-পালন করতেন এই ফাতেমা। ‘টুহাইয়া আইন্না খাইতো ছেলেডা। কুনো সময় হুনছি না ছেলেডা খারাপ কাম করছে। এইভাবে মাইরা ফালানিডা হেগর উচিত হইছে না।’ বলছিলেন সাগরের পাশের ঘরের বেগম নামের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মহিলা। জানা যায়, নিহত সাগরের পরিবার দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাস করে আসছে ওই বস্তিতে। সাগরের রয়েছে আরও পাঁচটি ভাই, দুটি বোন। হাসি-শিপনের সংসারে সাগর দ্বিতীয় সন্তান।

সর্বশেষ খবর