দুই দফা সংশোধনীর পরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীরা মনে করছেন তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের তৈরি করা পরিচয়পত্রে ভুল রয়েছে। ভুলটি হচ্ছে— পরিচয়পত্রে জাতীয়তায় ‘রোহিঙ্গা’র পরিবর্তে মিয়ানমার উল্লেখ রয়েছে। তাদের মতে, এখানে মিয়ানমারের পরিবর্তে ‘রোহিঙ্গা’ উল্লেখ থাকতে হবে। তাই দু-তিন দিন ধরে টেকনাফ ও উখিয়ার নিবন্ধন ক্যাম্পগুলোয় বয়স্ক কোনো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ যাচ্ছেন না। নিবন্ধন বুথগুলোয় কেবল শিশুদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে বয়স্কদের নিবন্ধিত হওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের একটি ‘দুষ্টচক্র’ আড়ালে থেকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা প্রশাসন মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে। শুরুতে ঢিমেতালে চললেও পরে নিবন্ধন বুথ বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজে কিছুটা গতিও ফিরে আসে। পরে বৃহত্তর পরিসরে উদ্যোগ নিয়ে এ কাজের দায়িত্ব নেয় পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। গতকাল পর্যন্ত ৫০টি নিবন্ধন বুথে প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু নিবন্ধিত হয়েছে। এর অধিকাংশই শিশু। সরেজমিনে উখিয়ার কুতুপালংয়ে রেজিস্ট্রার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্প কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ের সামনে রোহিঙ্গা শিশুর দীর্ঘ লাইন। একদল শিশু ছবি তুলে নিবন্ধিত হওয়ার লাইনে, আর একদল শিশু নিবন্ধন কার্ড হাতে পেতে লাইনে দাঁড়িয়েছে। দু-এক জন বয়স্ক নারীকে দেখা গেলেও তাদের মধ্যে তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি। নিবন্ধনে বয়স্করা নেই কেন— জানতে চাইলে রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্যক্রমের অন্যতম দায়িত্বশীল কর্মকর্তা লে. কর্নেল এ টি এম মোস্তফা কামাল জানান, বয়স্করা না এলেও কার্যক্রম থেমে নেই। শিশুদের নিবন্ধিত করা হচ্ছে। বয়স্কদের মধ্যে একটা দ্বিধা কাজ করছে— তাদের জাতীয়তা নিয়ে। মূলত তারা বিষয়টি বুঝতে পারছেন না বলেই এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তারা অবশ্যই মিয়ানমারের নাগরিক, তাই জাতীয়তায় রোহিঙ্গার স্থলে মিয়ানমারই হবে। কিন্তু তাদের দাবি জাতীয়তা হতে হবে ‘রোহিঙ্গা’। আসলে রোহিঙ্গা জাতীয়তা হতে পারে না।
তিনি আরও জানান, জাতীয়তা রোহিঙ্গা নাকি মিয়ানমার হবে, এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে মাইকিং করে প্রচার চালানো হচ্ছে। তাদের ভিতরে যারা শিক্ষিত তাদের দিয়েও বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নিবন্ধন বুথ আরও বাড়বে, এতে প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন বা পরিচয়পত্র দেওয়া যাবে। এ হারে চললে সময় তিন মাসের বেশি লাগবে না। রহিম নামে এক রোহিঙ্গার নিবন্ধন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়। নিবন্ধন কার্ডে দেখা যায় পিতার নাম : নাজির আহমেদ, মাতা : নূর বেগম, জন্ম তারিখ : ১৯৯৪ সালের ৮ আগস্ট, ধর্ম : ইসলাম, জন্মস্থান : মিয়ানমার, দেশ : মিয়ানমার, জাতীয়তা : মিয়ানমার, নিবন্ধনের তারিখ : ৯ সেপ্টেম্বর-২০১৭ এবং ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রাম : চরকম্বো, থানা : মংডু, জেলা : আকিয়াব ও দেশ : মিয়ানমার। ডান পাশে তার ছবি যুক্ত করা হয়েছে। কুতুপালংয়ে নতুন আশ্রয়শিবিরে থাকা আবদুল করিম নামে এক বৃদ্ধ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘আমরা মুসলিম রোহিঙ্গা। জাতীয়তার ক্ষেত্রেও তাই লিখতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে শুধু মিয়ানমারের অধিবাসী। যে পরিচয়ের জন্য জীবন দিতে হচ্ছে, দেশ ত্যাগ করতে হচ্ছে তাই যদি না পাই তাহলে বাংলাদেশে নিবন্ধন হওয়ারও কোনো যৌক্তিকতা নেই।’