শিরোনাম
রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিত ওরা

লোভনীয় চাকরি ও ব্যবসার ফাঁদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল অফিস। ম্যানেজমেন্টেও রয়েছেন ভারতীয় নাগরিক। লোভনীয় চাকরি, একই সঙ্গে ব্যবসায় অংশীদারি। এমন লোভনীয় অফার শুনে স্থির থাকতে পারেননি অবসরপ্রাপ্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও উচ্চপদস্থ আরও অনেক কর্মকর্তা। চাকরিজীবনের সঞ্চয়ের বড় অংশ বিনিয়োগও করেছেন তাদের ফাঁদে পড়ে। তবে কিছুদিনের মধ্যে অফিস উধাও হওয়ার পরই তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। সব হারিয়ে অবশেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দ্বারস্থ হন ভুক্তভোগীরা। পিবিআই বলছে, এরই মধ্যে ১২ জন ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে প্রতারক চক্রের পাঁচজন সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় তারা। শুধু এক যুগ্ম-সচিবের কাছ থেকেই চক্রটি এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন হারুন অর রশিদ (ছদ্মনাম রামনাথ ঠাকুর), সনজ সাহা ওরফে উজ্জ্বল চৌধুরী (ছদ্মনাম জি মোস্তফা কামাল), শামছুল আলম মজুমদার ওরফে কোপা শামছু (ছদ্মনাম মিজানুর রহমান), আমিনুল ইসলাম আমিন (৩৭) ও মোকসেদুর রহমান আকন (ছদ্মনাম আল-আমিন)। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পিবিআইর ঢাকা মহানগর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত ডিআইজি (পূর্ব) মো. মাইনুল হাসান বলেন, ‘গ্রেফতার ব্যক্তিরা প্রথমে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে চাকরির বিজ্ঞাপন দিত। ওই বিজ্ঞাপনে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, আর্মি ও সিভিল অফিসারদের প্রাধান্য দেওয়ার কথা আলাদা করে উল্লেখ থাকত। বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহীরা যোগাযোগ করলে সেখান থেকে তারা টার্গেট নির্ধারণ করত। এরপর সহযোগীদের মাধ্যমে তাদের নিজেদের সাজানো অফিসে নিয়ে যাওয়া হতো।’ মাইনুল বলেন, পল্লবীর ১১ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাসার দ্বিতীয় তলায় বিলাসবহুল অফিস বানিয়ে প্রতারণা করে আসছিল তারা। চক্রটি অফিসে পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরই আরেক সহযোগীকে স্যুট, টাই ও মাথায় হ্যাট পরিয়ে নিয়ে আসত। অনর্গল হিন্দিতে কথা বলে নিজেকে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিতেন ওই হ্যাট পরা লোক। একপর্যায়ে তারা ওই ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়েই তাস খেলা শুরু করত। খেলায় ভারতীয় ব্যবসায়ীকে হারিয়ে লাখ লাখ টাকা জিতেছে বলে দেখানো হতো। এভাবে টার্গেটে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের কৌশলে আস্থায় নিয়ে এসে ব্যবসার অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হতো। কথামতো ওই ব্যক্তি টাকা নিয়ে গেলে চক্রের সদস্যরা টাকা রেখে তাকে পরে যোগাযোগ করতে বলে বিদায় করে দিত। এরপর চক্রটি অফিসের জিনিসপত্র গুটিয়ে অন্যত্র চলে যেত।

পিবিআই ঢাকা মহানগরের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখন পর্যন্ত ১২ জন প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ নিয়ে এসেছেন। তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে তাদের ধারণা। গ্রেফতার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পিবিআই সূত্র বলছে, রাজধানীর মধ্য বাড্ডার বৈশাখী সরণির প-৭২/২ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা ফিরোজ খান (৬২)। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী। প্রতারক চক্রের চটকদার প্রলোভনে সাড়া দিয়ে পেনশনের টাকা থেকে সাত লাখ ৭৫ হাজার টাকা তাদের প্রজেক্টে বিনিয়োগের জন্য তাদের হাতে তুলে দেন ফিরোজ। তবে কয়েক দিন পরে ৫ জুন ওই অফিসের ঠিকানায় গিয়ে দেখেন সেখানে কোনো অফিস নেই। তাদের মুঠোফোনও বন্ধ। পরে ওই দিনই খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। দক্ষিণখান থানার আজমপুর এলাকার বাসিন্দা ভিকটিম গোলাম মোস্তফা (৬০)। সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে ৩০ লাখ টাকা তুলে দেন এই চক্রের সদস্যদের হাতে।

ভুক্তভোগীদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। থাকেন গুলশান এলাকায়। শিক্ষকতা জীবন শেষে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলবেন। গুলশান এলাকায় কাওসার নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কাওসার ওই শিক্ষককে জানালেন, একটি ভারতীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তার পরিচিত। তার নাম রামনাথ ঠাকুর। তিনিও বাংলাদেশে একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটি খুলবেন। যথারীতি কাওসার ওই শিক্ষককে রামনাথ ঠাকুরের কাছে নিয়ে গেলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে ওই শিক্ষক ২৮ লাখ টাকা তুলে দিলেন। একপর্যায়ে ওই শিক্ষকের সঙ্গে তারা পরিকল্পিতভাবে জুয়া খেলে আরও কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেন। এরপর ওই শিক্ষক যখন প্রতারণার বিষয়টি টের পেলেন, তখন লজ্জায় বিষয়টি পরিবারের কাছে গোপন রাখেন। পিবিআইর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জানান, আটক আসামিরা তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী ও বয়স্ক লোকদের বিদেশি সংস্থা বা প্রজেক্টে বেশি টাকা বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সাজানো অফিসে নিয়ে যেত। সেখানে ওই চক্রটি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিত।

সর্বশেষ খবর