কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার আগমনে নতুন করে বাসস্থানের হুমকিতে পড়েছে বনের পাহারাদার-খ্যাত এশিয়ান হাতি। এ তিন জেলার প্রায় ৬০ হাজার একর বনভূমিতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বসবাস তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে এই তিন জেলার পাহাড় ও বনভূমিতে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে এসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তিন জেলায় বনভূমির পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার ৮৭০ একর। এসব ভূমিতে এতদিন বন্যহাতির দল ঘুরে বেড়াত। খাবার খুঁজে নিত। কিন্তু এখন এসব অঞ্চলে হাতির খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নতুন নতুন আবাসস্থল তৈরি হওয়ায় ফলে গুরুতর হুমকির মুখে পড়েছে হাতির অভয়ারণ্য। এ ছাড়া হিমছড়ি ও টেকনাফ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এবং ফরেস্ট বন বিটও রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, হাতির জন্য যে বনভূমির দরকার- বনে এখন সে ধরনের পরিবেশ নেই। এ অবস্থায় এ অঞ্চলের হাতি বাধ্য হয়ে পাশের দেশে চলে যেতে পারে। বন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, গত ১৫ দিনে কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন বনে হাতির দেখা মেলেনি। এ ছাড়া গত এক মাসে বনের অস্তিত্ব কমে যাওয়ায় হাতি এখন লোকালয়েও আসতে শুরু করেছে। টেকনাফ ও লাউয়াছড়ায় প্রায়ই হাতি লোকালয়ে চলে আসছে। এ সময় টেকনাফে হাতির হামলায় দুই রোহিঙ্গার মৃত্যুও হয়েছে। এ ছাড়া লাউয়াছড়ায় বনের গহিন থেকে লোকালয়ে চলে আসায় দুই হাতিকে ধরাও হয়েছে। এ হাতি দুটি ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে। সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের বন এলাকায় ২২০ থেকে ৩৫০টি হাতির অস্তিত্ব রয়েছে। হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে বিগত ১২ বছরে ২২৬ জন মারা গেছেন। বনবিভাগ সূত্র জানায়, বাংলাদেশে স্থায়ী বন্যহাতির আবাসস্থল হচ্ছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ, বাঁশখালী, পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়া; কক্সবাজার জেলার কাসিয়াখালী, রামু, উখিয়া ও টেকনাফ; বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম। রাঙামাটি জেলার কাউখালী, কাপ্তাই ও লংদু এবং খাগড়াছড়ি জেলাসহ দেশের ১১টি বনবিভাগে এদের বিচরণ দেখা যায়। ড. রেজা খানের জরিপ অনুযায়ী, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে বন্যহাতির সংখ্যা ছিল ৩৮০টি। ২০০০ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বন্যহাতির সংখ্যা ২৩৯টি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর করা জরিপে পাওয়া যায় ২২৭টি।
পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। পৃথিবীতে দুই প্রজাতির হাতি রয়েছে- এশিয়ান প্রজাতি ও আফ্রিকান প্রজাতি। যদিও শারীরিকভাবে দেখতে প্রায় একই রকম তবু এদের মধ্যে জৈবিক পার্থক্য রয়েছে। কক্সবাজার জেলার বন কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের বসতি তৈরির পর মাত্র এক দিন হাতির দেখা মিলেছে। ফলে তারা আশঙ্কা করছেন, বন থেকে নিরাপত্তার কারণে হাতির দল স্থান ত্যাগ করতে পারে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের হাতি এশিয়ান প্রজাতির। আফ্রিকান প্রজাতির হাতি পুরুষ ও স্ত্রী উভয়েরই দাঁত গজায়। কিন্তু এশিয়ান প্রজাতির ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ হাতির দাঁত গজায়। একটি হাতি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ কেজি খাবার খায়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হাতির ওজন ৫ টন। আর স্ত্রী হাতির ওজন ৪ টনের কিছু বেশি হতে পারে। স্ত্রী হাতি সাধারণত একবারে একটি বাচ্চা দেয়। এদের গর্ভধারণকাল ২২ মাস। দুবার ৪ বছর পরপর স্ত্রী হাতি বাচ্চা দেয়। জন্মের সময় বাচ্চার ওজন ৯০ কেজি। হাতির খাদ্য বাঁশ, কলাগাছ, ফলদ উদ্ভিদ ও তৃণলতা। দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে হাতি। এদের স্বাভাবিক গতি ঘণ্টায় ২৫ মাইল। আইসিইউএনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী বনবিভাগের চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে হাতি আছে ৩০ থেকে ৩৫টি। কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগ মিলিয়ে আছে ৮২ থেকে ৯৩টি। বান্দরবানে আছে ১২ থেকে ১৫টি এবং লামা বিভাগে আছে ৩৫ থেকে ৪০টি হাতি। এ ছাড়া কক্সবাজার উত্তর বিভাগে আরও ৭ থেকে ৯টি এবং দক্ষিণ বিভাগে ৩০ থেকে ৩৫টি হাতি রয়েছে। আর অভিবাসী হাতির সংখ্যা ৮৪ থেকে ১০০টি। বাংলাদেশে হাতি কমে যাওয়ার ৯টি কারণ আইসিইউএনের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বনাঞ্চল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, খাদ্য সংকট, চলাচলের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া, যত্রতত্র জনবসতি গড়ে ওঠা এবং চোরা শিকারিদের নিষ্ঠুরতা। তবে ভয়ঙ্কর হচ্ছে চোরা শিকারিদের উপদ্রব। ২০০১ থেকে ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার ৬টি উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দাঁত ও হাড়গোড়ের জন্য ১৫২টি হাতি হত্যা করা হয়।দুই প্রজাতির বৈশিষ্ট্য : এশিয়ান হাতি ৬-১১ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। আফ্রিকান হাতি হয় ৬-১৩ ফুট। গড় ওজন এশিয়ান হাতির যেখানে ৩-৫ টন। আফ্রিকান হাতির সেখানে ২-৭ টন। এশিয়ান হাতির গায়ের রং বেশ ফরসা ও মসৃণ। আফ্রিকান হাতির গায়ের রং কালসেটে ও কুঁচকানো। কানের আকৃতি নিশ্চিত করে দেয় কোনটা আফ্রিকান আর কোনটা এশিয়ান। আফ্রিকান হাতির আছে প্রকাণ্ড কান, যা দিয়ে প্রচণ্ড গরমে বাতাস করে নিজের গা নিজেই জুড়িয়ে নিতে পারে। পক্ষান্তরে এশিয়ান হাতির আছে ছোট কান। পেটের আকৃতিতেও দেখা যায় ভিন্নতা। এশিয়ান হাতিদের পেট গলা থেকে নিচের দিকে অনেকটা সমান। আর আফ্রিকানদের বেলায় গলা থেকে পেট ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে ঝুলে আসে। এশিয়ান হাতির বুকের পাঁজরের হাড় এক জোড়া কম অর্থাৎ আফ্রিকান হাতির রয়েছে ২১ জোড়া হাড় আর এশিয়ান হাতির ২০ জোড়া। আফ্রিকান স্ত্রী পুরুষ উভয় হাতির প্রলম্বিত দাঁত আছে, কিন্তু এশিয়ান হাতির ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ হাতির এই দাঁত দেখা যায়। এশিয়ান হাতির শুঁড় তুলনামূলক শক্ত এবং এর শেষ প্রান্তে একদিক সামান্য বেরিয়ে থাকে আঙ্গুলের মতো। যা তাকে যে কোনো জিনিস শক্তভাবে ধরতে সাহায্য করে। আফ্রিকান হাতির শুঁড়ের শেষ প্রান্তে দুদিক বেরিয়ে থাকে। খাদ্য পছন্দের তালিকায় এশিয়ান হাতি বেশি পছন্দ করে ঘাস, পক্ষান্তরে আফ্রিকান হাতির পছন্দ পাতা। একটি হাতির গড় আয়ুষ্কাল ৬০-৭০ বছর।