বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাস যে কারণে বেপরোয়া

সাঈদুর রহমান রিমন

বাস যে কারণে বেপরোয়া

রাজধানীতে হরহামেশাই ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন বাসচালকরা —জয়ীতা রায়

বাস মালিকরা অর্থবিত্তে বলীয়ান, রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রতাপশালী; চাঁদার টাকায় গড়ে তোলা বেতনভুক্ত ক্যাডার বাহিনীও আছে তাদের। মোটা অঙ্কের মাসোহারার টাকায় আজ্ঞাবহ রাখেন থানা-পুলিশ, ট্রাফিক-প্রশাসন। প্রকাশ্য চাঁদাবাজি, মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে মারাত্মক সব অপরাধ ঘটিয়েও তারা বরাবরই থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। দাপুটে মালিকদের ক্ষমতা, প্রতাপ আর তোয়াক্কাহীনতায় তাদের বাস-মিনিবাসগুলো আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মালিকদের মাসোহারার সুবাদে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ও ইচ্ছাকৃত অপরাধ ঘটিয়ে বেমালুম রেহাই পেয়ে যান সংশ্লিষ্ট বাস-মিনিবাসের চালক-সহকারীরা। তারা গাড়ির ভিতরে যাত্রীদের নানাভাবে হেনস্থা করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, ইদানীং গাড়ির ভিতরে নারী যাত্রীদের আটক রেখে গণধর্ষণসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতেও দ্বিধা করছে না।

শাস্তি পেতে হয় না বলেই চালক-হেলপারদের মধ্যে দিন দিনই অসতর্ক, অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বেড়েছে, ফলে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে দুর্ঘটনা আর হতাহতের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরাও অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, শাস্তি না পাওয়া, পুলিশের দায়িত্বহীনতা, বিআরটিএর দুর্নীতি দিন দিনই সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রাকে আকাশচুম্বি করে তুলেছে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দুর্ঘটনায় একজন মানুষের মৃত্যু মানেই একটি পরিবারের সারা জীবনের দীর্ঘশ্বাস বয়ে আনে। সড়কের এ করুণ পরিণতি থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রাফিক কর্মকর্তারা জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আইন-কানুন মানছে না বলে দিন দিনই দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশে আইন আছে, রয়েছে শাস্তির বিধান। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ সন্তোষজনক নয়। তাই সড়ক-দুর্ঘটনার দায়ে অভিযুক্ত চালকদের সাজা ভোগের নজিরও দেখা যায় না।

ফিটনেসবিহীন গাড়ির ছড়াছড়ি : রাজধানীজুড়ে এখন লক্কড়-ঝক্কড় ফিটনেসবিহীন গাড়ির ছড়াছড়ি। অবাধে চলাচল করছে যাত্রীবাহী এসব গাড়ি। তদারকির কেউ নেউ। মালিকশ্রেণি বলছে গেল মাসে শেষ হওয়া টানা তিন মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক গাড়ি পুড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এখনো ঠিক করা সম্ভব হয়নি। তাই এখন ভাঙ্গা গাড়ি রাস্তায় নামানো ছাড়া কোনো পথ নেই। ট্রাফিক পুলিশও উদাসীন রয়েছে এসব গাড়ি আটকানোর ব্যাপারে। এসব যানবাহনের মধ্যে বেশির ভাগই রয়েছে বাস ও লেগুনা। দেশে নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ির মধ্যে প্রায় তিন লাখের প্রকৃতপক্ষে ফিটনেস নেই। এর মধ্যে প্রায় ৬৭ হাজার গাড়ি ১০ বছর বা এরও বেশি সময় ধরে ফিটনেস পরীক্ষা তো দূরের কথা, কোথায় চালানো হচ্ছে তা জানাচ্ছে না বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে। এসব গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। এ ধরনের ফিটনেসহীন গাড়িও সড়কে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। উদাহরণ উল্লেখ করে পরিবহনের একজন দায়িত্বশীল শ্রমিক নেতা জানান, সায়েদাবাদ-টঙ্গী-গাজীপুর রোডে বিভিন্ন পরিবহনের প্রায় এক হাজার গাড়ি চলাচল করলেও এরমধ্যে মাত্র ৭০/৮০টি গাড়ির ফিটনেস ও কাগজপত্র আপ-টু-ডেট আছে। অথচ একটি রাটেই কাগজপত্রহীন ৯ শতাধিক গাড়ি কীভাবে চলছে তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশের চারটি বিটে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই গাড়িগুলো অবাধে চলাচল করে থাকে। পরিবহন মালিক সমিতির আরেক নেতা জানান, মিরপুর থেকে বিভিন্ন কোম্পানির যেসব গাড়ি উত্তরার পথে যাতায়াত করে— সে গাড়িগুলো আব্দুল্লাহপুর হয়ে শুধু ইউটার্ন নেওয়া বাবদ সেখানকার টিআইকে প্রতি মাসে ১০ লক্ষাধিক টাকা মাসোহারা দিতে হচ্ছে। ট্রাফিকের বিটগুলোতে এভাবেই চলে মোটা অঙ্কের মাসোহারা হাতানোর ধান্ধাবাজি। এগুলো পূরণ করেই গাড়ি মালিকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

ট্রিপভিত্তিক মজুরিতেই চলে পাল্লাপাল্লি : আইনে মোটরযান শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া ও দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৩৪ বছর ধরে পরিবহন মালিকরা তা মানছেন না। মাসিক বেতন না থাকায় প্রায় ৯৫ শতাংশ চালকই রোজগারের জন্য দিনে আট ঘণ্টার বদলে ১৪ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। দৈনিক ট্রিপনির্ভর বেতন হওয়ায় বাড়তি আয়ের জন্য স্থানে স্থানে যাত্রী তোলেন তারা। বিশ্রাম না নিয়ে, নির্ঘুম কাটিয়ে আয় করা বাড়তি টাকার পুরোটা অবশ্য তারা ঘরে নিতে পারেন না। মালিক ছাড়াও এর ভাগ দিতে হয় পুলিশ ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের। ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথ এবং টার্মিনালে দূরপাল্লার ও লোকাল গাড়ির চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দূরপাল্লার হাতে গোনা কয়েকটি বাস কোম্পানি মাসিক ভিত্তিতে চালকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। বেসরকারি হিসাবে, ৯৫ শতাংশ মালিকই নিয়োগপত্র দিচ্ছেন না, এমনকি খোরাকিও না। চালকদের উল্টো ট্রিপনির্ভর করে তুলছেন গাড়ি চালনায়। এতে কম সময়ে বেশি ট্রিপ দিতে তারা বেশি গতিতে ও ওভারটেক করে গাড়ি চালাচ্ছেন। শ্রমিক নেতা ওসমান আলী বলেন, মহাসড়কে ও স্থানীয় সড়কে একই অবস্থা। জানা গেছে, ঢাকা শহরে ৪২টি  কোম্পানির বাসে চালক, তাদের সহকারী ও কন্ডাক্টরদের বেতন দেওয়া হয় দৈনিক ট্রিপ ভিত্তিতে। এতে বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি আয় করতে চালকরা স্থানে স্থানে যাত্রী তোলেন, নামান। ঢাকা মহানগরীতে ২০০টি বাস থামার স্থান আছে। তবে এসব স্থানে বাস না থামিয়ে পুরো রুটের স্থানে স্থানে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন রোডে চলা দূরপাল্লার বাসের চালকরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একে অন্যের সঙ্গে গতির প্রতিযোগিতা করছেন। এই গতির কারণে বেড়ে যাচ্ছে দুর্ঘটনার গতি। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী অভিযোগ করেন, ‘সড়কে প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোর হাজারো অভিযোগ আমরা পেয়েছি। মালিকরা তার গাড়িটি দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চালকদের ওপর চাপ দেন। আমরা এমন অভিযোগ প্রায়ই পেয়ে থাকি। মহাসড়কে একটি গাড়ির গতি ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত তোলারও নজির রয়েছে।’ তবে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতার বিষয়টি অস্বীকার করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আসলে হাইওয়েতে প্রতিযোগিতা হয় না। হাইওয়ের পথ দীর্ঘ। বিষয়টা এমন নয় যে সে একবার ট্রিপ দিয়ে আবার একটি ট্রিপের জন্য প্রস্তুত হবে। এ ছাড়া হাইওয়েতে চলাচলকারী যানবাহনগুলো অনেক দামি। কোনো মালিক তার চালককে বলবেন না প্রতিযোগিতা করতে। কারণ, তিনি চাইবেন না তার গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। মালিকের যেমন তার গাড়িটির জন্য মায়া আছে, ঠিক চালকেরও তার জীবনের জন্য মায়া আছে।’

এত হত্যা এত ক্ষতি তবু নেই শাস্তি  : সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যাজনিত মামলাতেও সাজা ভোগের নজির খুব কম। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী গাড়ির চালক-মালিকরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ কারণে একশ্রেণির চালক-শ্রমিক দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এত জানমালের ক্ষতি সাধনকারী দুর্ঘটনার কোনোটিতেই ঘাতক গাড়িচালক ও মালিকদের আদালতে শাস্তি পেতে হয় না। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটি কয়েক ঘণ্টার বেশি আটকেও রাখা যায় না। পুলিশের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ঘাতক চালকের পরিবর্তে ভাড়াটে হেলপার হাজত খাটেন। ঘাতক চালক পরমুহূর্ত থেকেই মালিকের অন্য কোনো গাড়িতে বহাল তবিয়তে ডিউটি করে থাকেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে এমন তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে।

পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে ‘মারা গেলে ২০ হাজার, আধমরায় ৫ হাজার’ কথাটি প্রবাদ বাক্যের মতোই প্রচলিত হয়ে আছে। এর অর্থ হচ্ছে, বেপরোয়া গাড়ি চালানোজনিত দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে মিট-মীমাংসার নামে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। আর মারাত্মক আহত কিংবা আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণকারীর জন্য এই বরাদ্দ সর্বোচ্চ হাজার পাঁচেক টাকা।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারি উদ্যোগ : দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো ব্ল্যাক স্পট নাম দিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সারা দেশে ২০৮টি ব্ল্যাক স্পটের তালিকা তৈরি করেছে। যৌথ গবেষণার এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে সড়ক বা মহাসড়কের ওপর গড়ে তোলা বাসস্ট্যান্ডগুলোতেই। সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্ত, চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা ও ব্যাটারিচালিত অবৈধ যানবাহন বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। আর পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারে প্রচার চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর