বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৩৩

পথের কাঁটা সরানোর রোমহর্ষক মিশন

মির্জা মেহেদী তমাল

পথের কাঁটা সরানোর রোমহর্ষক মিশন

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ডেমরার শুকরশির একটি গ্যারেজের কাছে রক্তাক্ত এক যুবকের লাশ দেখে পথচারী ভিড় করে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন। কেউ তাকে শনাক্ত করতে পারছিল না। খবর পেয়ে আসে পুলিশ। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে। লাশ পাঠায় মর্গে। এদিকে যাত্রাবাড়ীর পাথর ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান নিখোঁজ ছিলেন এক দিন আগে থেকে। অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের সংবাদ শুনে কামরুজ্জামানের বাবা আশেক আলীর বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। অজানা আশঙ্কায় তিনি ছুটে যান যাত্রাবাড়ী থানায়। কিন্তু লাশ ততক্ষণে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে। আশেক আলী সময় নষ্ট না করে ছোটেন মর্গে। লাশ পড়ে ছিল লাশ কাটা ঘরের কোনায়। লাশের কাছে গিয়েই গগনবিদারী চিৎকার তার। চোখের সামনে সন্তানের লাশ দেখে তিনি আর ঠিক থাকতে পারেননি। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। স্বজনরা থামিয়ে রাখতে পারছিল না। এ ঘটনায় ডেমরা থানায় অপহরণের পর হত্যার অভিযোগে মামলা করেন বাবা আশেক আলী।

থানা পুলিশ তদন্ত করে। খুনের কোনো ক্লু খুঁজে পায় না। খুনিদের শনাক্তও করতে পারছে না পুলিশ। কামরুজ্জামানের ব্যবসায়িক পার্টনারদের দিকেই পুলিশের সন্দেহ। কিন্তু খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন এমন কাউকে তাদের চোখে পড়ছে না। পরিবার থেকেও পুলিশকে বলা হয় তার কোনো শত্রু ছিল না। ব্যবসা একাই করতেন। পুলিশের তদন্ত এক প্রকার থেমে থাকে।

একপর্যায়ে মামলাটির তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গোয়েন্দারা খুনের তদন্ত করে যে তথ্য জানতে পারেন তা নিজেরাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। গোয়েন্দাদের মতে, এমন ঘটনা খুব বিরল। খুনি চারজনকেই শনাক্ত করার পর গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছেন কামরুজ্জামানের ৪৪ বছর বয়সী মা মরিয়ম বেগম এবং তার পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রেমিক আজিজুল হক। শুধু তাই নয়, খুনের পর তারা পার্টি দিয়েছেন। দুই হাতে টাকা উড়িয়েছেন। গোয়েন্দারা বলছেন, পরকীয়া এমন একটি হিংস্রতায় নিয়ে গেছে, নিজ সন্তানকে পথের কাঁটা ভেবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছেন মা নিজেই। কিন্তু তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি। সুখের বদলে যেতে হয়েছে কারাগারে। খুনের দায়ে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে। মায়ের ইচ্ছায় ছেলেকে হত্যার এমন মর্মান্তিক ও অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ২০১৪ সালের আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তার। ১৩ আগস্ট কামরুজ্জামানের লাশ উদ্ধার করা হয়। ১২ আগস্ট দুপুরে বাহিরটেংরার ওরিয়েন্টাল স্কুলের সামনের বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি তিনি। রাত ১০টা থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন দুপুরে লাশ উদ্ধার হয়। শুরুতে পুলিশের ধারণা ছিল ব্যবসায়িক বিরোধের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড। পরে মামলাটি স্থানান্তর হয় ডিবিতে। ডিবির মোবাইল ট্র্যাকিংসহ প্রযুক্তির ব্যবহারে মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা।

ঘটনার শুরু : রাজধানীর ডেমরার বাহিরটেংরা এলাকার গৃহবধূ মরিয়মের মোবাইল ফোনে একটি মিসড কল আসে। ওই নম্বরে কল করতেই রিসিভ করেন আজিজুল হক নামে এক ব্যক্তি। কথায় কথায় দুজনের সম্পর্ক গড়ায় পরকীয়ায়। স্বামী-সন্তান আর এলাকাবাসীর চোখ এড়িয়ে দেখা করতেন ডেমরায় নতুন ভাড়া নেওয়া একটি ফ্ল্যাটে। সেখানে ছয় মাস ধরে নিয়মিত দুজনের মেলামেশা হতো। কিন্তু কিছু দিন পর বিষয়টি টের পেয়ে যান মরিয়মের ছেলে ও ডেমরার পাথর ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। কিন্তু ঘটনা বাকবিতণ্ডায় থেমে থাকেনি। মরিয়ম তার সন্তানকেই হত্যার পরিকল্পনা করেন প্রেমিক আজিজুলকে সঙ্গে নিয়ে। নাটকের কাহিনীর মতো সন্তানকে হত্যা করে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন পুত্রবধূ নূরজাহানকে। পুলিশের হাতে ২ অক্টোবর গ্রেফতার হওয়ার পর জেরার মুখে সেই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন মা ও তার প্রেমিক এবং দুই সহযোগী।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার প্রায় এক বছর আগে মোবাইল ফোনে মিসড কলের মাধ্যমে মরিয়ম বেগমের সঙ্গে আজিজুল হকের যোগাযোগ হয়। মরিয়মের স্বামী মো. আশেক আলী প্রায় ২০ বছর ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ ও দৈহিক মেলামেশায় অক্ষম ছিলেন। একপর্যায়ে ৫০ বছর বয়সী ব্যবসায়ী আজিজুল হকের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন ৪৪ বছর বয়সী মরিয়ম। পরকীয়ার জেরেই হত্যাকাণ্ডের মাস ছয়েক আগে ডেমরায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সেখানেই মেলামেশা করতেন তারা। কিছু দিন পর মরিয়মের ছেলে কামরুজ্জামান মায়ের অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি টের পান। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। এ ছাড়া কামরুজ্জামান তার এক খালাতো বোনকে পছন্দ করতেন। তাতেও বাধা হয়ে দাঁড়ান মরিয়ম। তিনি ছেলেকে অন্যত্র বিয়ে করান।

একপর্যায়ে মরিয়ম ছেলেকে পরকীয়ায় পথের কাঁটা ভেবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ছেলে মারার দায়িত্ব দেন প্রেমিক আজিজুল হককে। নিজেই খরচ বহনের কথাও জানান। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ১২ আগস্ট সন্ধ্যায় মরিয়ম বেগম তার ছেলে কামরুজ্জামানকে নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা বলেন। বিষয়টি জানার পর কামরুজ্জামান তাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য খিলগাঁওয়ের খিদমাহ হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে গিয়ে মরিয়ম প্রেমিক আজিজুল হককে মোবাইলে কামরুজ্জামানের হাসপাতালের সামনে অপেক্ষার খবর জানিয়ে দেন। কামরুজ্জামানকে আগে থেকেই চিনতেন আজিজুল। এর পরও তার হাতে ছেলের ছবি দিয়ে রাখেন মরিয়ম; যাতে ভুল না হয়। তবে আজিজুলকে চিনতেন না কামরুজ্জামান। হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমাণ পাথর ব্যবসায়ী কামরুজ্জামনকে দেখে বেশ কয়েক ট্রাক পাথর কেনার বিষয়ে কথা বলেন আজিজুল। হাসপাতালের পাশে পার্কিং করা আজিজুলের মাইক্রোবাসে বসে কথা বলেন তারা। কথা বলার সময় কামরুজ্জামানকে নিজের গাড়িতে থাকা কফি খাওয়ানোর আবদার করেন আজিজুল। কফি পান করে কামরুজ্জামান গাড়িতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অচেতন অবস্থায় আজিজুলের দুই সহযোগী তাফাজ্জাল ও মঞ্জুরুল হক সিটবেল্ট দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন কামরুজ্জামানকে। নাটকীয়ভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মোবাইল ফোনে মরিয়ম বেগমকে ছেলের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন আজিজুল। এরপর ডেমরার ফ্ল্যাটে মরিয়ম বেগম তাদের সঙ্গে দেখাও করেন। পার্টি করেন। চুক্তি অনুযায়ী দুই সহযোগী তাফাজ্জাল ও মঞ্জুরকে ১০ হাজার টাকা দেন মরিয়ম। হত্যাকাণ্ডের পর কামরুজ্জামনের স্ত্রী নূরজাহানের ওপর কৌশলে এর দায়ভার চাপানোর চেষ্টা করেন মরিয়ম। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, হত্যাকাণ্ডের দিনই কৌশলে আলমারি থেকে ১ লাখ টাকা সরিয়ে রাখেন মরিয়ম। সেই টাকা দিয়েই ছেলেকে খুন করান। চুরির দায়ভার কামরুজ্জামানের স্ত্রী নূরজাহানের ওপর দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কামরুজ্জামানের দুই বোন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাদের ভাইয়ের বউ চুরির ঘটনা ঘটাতে পারেন।

গোয়েন্দারা জানান, পরকীয়ায় তারা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠেছিলেন যে, সন্তানকে খুনের পরও মায়ের ভিতর কোনো অনুশোচনা ছিল না। গোয়েন্দারা নতুন করে তদন্ত প্রক্রিয়ায় কামরুজ্জামানের মা এবং তার প্রেমিক ও প্রেমিকের অন্য দুই বন্ধুর গতিবিধির ওপর নজর রাখেন। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, তাদের মেলামেশা আগের থেকে আরও বেড়ে যায়। এরপর মোবাইল ট্র্যাকিং করে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন যে, খুনের সঙ্গে মা ও তার প্রেমিক জড়িত। ঘটনার প্রায় আড়াই মাস পর নিশ্চিত হয়ে গোয়েন্দারা তাদের গ্রেফতার করেন। ছেলেকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে সুখের সংসার গড়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মা, তা ভেস্তে যায়।

সর্বশেষ খবর