বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
নাটোর

উত্তরা গণভবন তুমি কার

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর

উত্তরা গণভবন তুমি কার

নাটোরের ঐতিহ্যের শত বছরের ইতিহাসের স্মারক উত্তরা গণভবন। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় কার্যালয় এখন অরক্ষিত। শত বছরের প্রাচীন এই স্থাপনার জায়গা দখলের মহোৎসব নিয়ে একাধিক সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে খবর প্রচার করা হয়। এত দিন গণভবনের সীমানাপ্রাচীরের বাইরে দখল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলেও এখন লুটেরাদের চোখ পড়েছে গণভবনের ভিতরে। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রশাসনের তৈরি হয়েছে বৈরিতা। জেলা প্রশাসন, সরকারি দফতর ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে নিপতিত প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন নাটোরের উত্তরা গণভবন। তদন্ত কমিটি কাজ শুরুর আগেই গণপূর্ত বিভাগের চার কর্মকর্তার নামে মামলার সিদ্ধান্ত সমালোচিত হচ্ছে জেলাজুড়ে। বিশেষ করে গাছ কাটার ঘটনায় করা মামলায় গণপূর্ত বিভাগের কর্মচারী ও নাটোরের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবদুস সবুর তালুকদারকে জড়ানোর ঘটনায় চলছে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ। অনেকে মনে করছে গাছ কাটার ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচাতে সবুর তালুকদারের মতো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীকে ‘বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে । গণপূর্ত বিভাগের দুই কর্মকর্তা এবং গণভবনের কেয়ারটেকার আবুল কাশেম ও আবদুস সবুরের ওপর দোষ চাপিয়ে গাছ কাটার ঘটনার মূল কুশীলবকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। গণভবনকে ঘিরে শহরজুড়ে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, সর্বসাধারণের জন্য ঐতিহাসিক এ স্থাপনা উন্মুক্ত করে দেওয়াই কাল হয়েছে গণভবনের জন্য। কারও কারও মতে, গণভবনের শতবর্ষী বৃক্ষই এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ। আবার কারও মতে, গণভবনের কর্তৃত্ব গণপূর্ত বিভাগের কাছ থেকে নিজ আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করছে জেলা প্রশাসন। অনেকের ধারণা, গণভবনের মতো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার কর্তৃত্ব জেলা প্রশাসনের আয়ত্তে থাকলে বিভিন্ন সময় রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তোলা বিতর্কের অবসান হবে। কেউ ভাবছেন, গণভবনের শতবর্ষী গাছ ও দিঘির মাছকে টার্গেট করে এগোচ্ছিলেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। আর গাছ কাটার ঘটনা একটা টেস্ট কেস ছিল তাদের জন্য। গত কয়েক দিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, কয়েক দশক ধরে দুর্লভ বৃক্ষরাজি ও সুবিশাল দিঘির মাছের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে গণপূর্ত বিভাগ। তাদের নিয়োজিত তত্ত্বাবধায়করা মূলত গণভবনে সর্বসাধারণের প্রবেশ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। সঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে আনসার ও পুলিশ। কয়েক দশক ধরে গণভবনের ভিতরই অবস্থান করছেন তত্ত্বাবধায়ক ও নিরাপত্তাকর্মীরা। এত দিন বিতর্ক না থাকলেও সম্প্রতি গাছ কাটার ঘটনায় প্রশ্ন ওঠে এ নিয়ে। বাদ যায়নি জেলা প্রশাসনের নীরব ভূমিকার বিষয়টিও। এদিকে গাছ কাটার ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর নড়েচড়ে বসা প্রশাসন চাপের মুখে গঠন করেন তদন্ত কমিটি। ১৭ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় স্থানীয় এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের তোপের মুখে পড়েন জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগের কর্তারা। সভায় তিনি গাছ কাটার সঙ্গে জড়িতদের বের করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন। সেদিন গণভবন ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয় গাছ কাটার ঘটনায় অভিযুক্ত গণভবনের দুই তত্ত্বাবধায়ক আবুল কাশেম ও আবদুস সবুর তালুকদারকে। তত্ত্বাবধায়ক আবুল কাশেম জানান, ভবন ছাড়ার জন্য বুধবার তিনি তার দাফতরিক নির্দেশপত্র পাওয়ার পরপরই ভবন খালি করতে থাকেন। বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে নিজের প্রায় ৯০ ভাগ মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন। এদিকে গণভবনের গাছ কাটার ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবিতে সোচ্চার একাত্তর পরিষদ। পরিষদের সভাপতি কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বলেন, ‘উত্তরা গণভবন একটি সংরক্ষিত এলাকা। তাই সেখানে কী ঘটছে তা মানুষ সহজে জানতে পারে না। এই অবৈধ গাছ কাটা চলছে অনেক দিন ধরে। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি সবে। এই অপকর্মের দায়ভার বেশ কয়েকটি বিভাগ ও ব্যক্তির। এর মধ্যে আছে গণপূর্ত বিভাগ, বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন, ঠিকাদার ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, অমূল্য গাছগুলো কাটার সঙ্গে জড়িত রাঘব-বোয়ালদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে জেলা প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জহির উদ্দীন এবং কলেজ শিক্ষক সাজেদুর রহমান সেলিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন গণভবনের তত্ত্বাবধায়ক কাশেমসহ আরও তিন চুনোপুঁটির নামে মামলা দিয়ে ঘটনার মূল হোতা রাঘব-বোয়ালরা নিজেদের পরিষ্কার দেখাতে চাইছেন। এ ঘটনার যদি বিচার না হয় তবে নাটোরের ইতিহাসে তা কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। তারা জাতীয় ও বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন উত্তরা গণভবন রক্ষায় উপযুক্ত পদক্ষেপের দাবি করেন।

অবৈধভাবে গাছ কাটার জন্য ৬ জনকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন: নাটোরের উত্তরা গণভবনের অবৈধভাবে গাছ কাটার জন্য ছয়জনকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলাম। সোমবার সন্ধ্যায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তিনি। প্রতিবেদন পাওয়ার পর সন্ধ্যা ৭টায় জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে প্রেসব্রিফিং করেন। তিনি বলেন, গণভবনের অবৈধভাবে গাছ কাটার সঙ্গে নাটোরের গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান আকন্দসহ তার বিভাগের পাঁচজন ও ঠিকাদার জড়িত। তদন্ত প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাঠানো হবে বলে তিনি জানান। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যে পরামর্শ দেবেন সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলাম বলেন, বনবিভাগ পাঁচটি মরা গাছ ও নয়টি গাছের ডাল বিক্রির জন্য ১৮ হাজার ৪০০ টাকার মতামত দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই পাঁচটি মরা গাছ ও নয়টি গাছের ডাল বিক্রির জন্য টেন্ডার হয়। টেন্ডারের নিয়ম ভেঙে গণপূর্ত বিভাগের সহযোগিতায় কাটা হয় ১৭টি গাছ ও ৪৩টি গাছের ডাল। যার মূল্য ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রসঙ্গত, গণভবনের গাছ কাটার ঘটনায় ১৭ অক্টোবর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক শাহীনা খাতুন। কমিটির অন্য সদ্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খায়রুল আলম, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বানু, নাটোর র‍্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার আনোয়ার হোসেন ও এনডিসি অনিন্দ্য মণ্ডল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর