বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৬২

কেটে পুড়িয়েও নিশ্চিহ্ন হয়নি লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

কেটে পুড়িয়েও নিশ্চিহ্ন হয়নি লাশ

‘হ্যালো! মতিঝিল থানা, ডিউটি অফিসার বলছি! কে বলছেন প্লিজ?’ পুলিশ কর্মকর্তা ল্যান্ড ফোনে আসা কলের জবাব দিচ্ছিলেন। অপরপ্রান্ত থেকে কিছু শুনেই তিনি বলছেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে’। ফোন রেখেই ওয়্যারলেস করলেন মোবাইল ডিউটি টিমকে। ফকিরাপুলের কালভার্টে যাওয়ার কথা বললেন পুলিশের দলকে। এরপর মোবাইল ফোনে পদস্থ কর্মকর্তাদের জানালেন তিনি। পুলিশ এ খবরে কিছুটা বিচলিত। ফকিরাপুল কালভার্ট সড়কের উপবন হোটেলের সামনে মানুষের জটলা। পুলিশের দল পৌঁছে গেছে সেখানে। লোকজনের  ভিড়ে তারা ভিতরে ঢুকতে পারছে না। লোকজনের চেহারায় আতঙ্ক। পুলিশ একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়ায়। লাশ নয়, লাশের খণ্ডিত অংশ। একটি হাত ও একটি পায়ের কাটা অংশ! ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে চলে এসেছে র‌্যাব ও ডিবির দল। হাত ও পায়ের অংশ যেহেতু পাওয়া গেছে, বাকি অংশগুলোও পাওয়া যাবে। গোয়েন্দারা নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর এমন ধারণা করছেন। বাকি অংশগুলোর সন্ধান শুরু করলেন তারা। এরপর ফকিরাপুল ওয়াসা ভবনের দেয়ালের পাশ থেকে আরেকটি পা উদ্ধার হলো। একটু দূরে ময়লা-আবর্জনার ভিতর থেকে পাওয়া গেল হাত ও একটি বাহু। তবে মানুষের দেহের এই খণ্ডিত অংশগুলো বিকৃত-আগুনে পোড়া। এগুলো খুঁজতে গিয়েই দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা।

তখনো গোয়েন্দারা বুঝতে পারছিলেন না, শরীরের এই অংশগুলো নারী না পুরুষের। আর এক ব্যক্তির কিনা। তবে গোয়েন্দারা হাল ছাড়লেন না। পুরো এলাকায় তল্লাশি চলছে। একপর্যায়ে ফকিরাপুল পানির ট্যাংকির পূর্ব পাশে ওয়াসার স্টোর রুমের টিনের চালে চোখ গেল এক গোয়েন্দার। কাপড়ের পোঁটলা ঝুলতে দেখলেন তিনি। সন্দেহ হলো তার। সামনে গিয়ে দেখলেন বিছানার চাদর দিয়ে বাঁধা কিছু ঝুলে আছে। রক্তের মতো লাল দাগও রয়েছে। টিনের চালায় উঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা বিছানার চাদরটি তুলে নিলেন। পোঁটলার গিঁট খুললেন। আঁতকে উঠলেন তিনি। রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। মাথার একটি অংশ। আর রয়েছে হাত-পাবিহীন একটি মানব দেহ!

২০১৫ সালের ১০ মার্চের ঘটনা এটি। দুপুর থেকে রাত অবধি গোয়েন্দাদের তল্লাশিতে উদ্ধার হয়েছিল এক নারীর লাশের দশ টুকরা। ফকিরাপুলের চারটি ভবনের ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল খণ্ডিত অংশগুলো। হত্যার পর কেটে টুকরো টুকরো করে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল অপরাধীরা। তাকে হত্যার পর লাশ ১০ টুকরো করে শুধু বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়েই রাখা হয়নি। যাতে শনাক্ত করা না যায় সেজন্য তা আগুনে পোড়া হয়েছিল। তারপরও আধুনিক বিজ্ঞান আর তদন্তকারীদের আন্তরিকতায় সেই হতভাগ্য নারীর পরিচয় জানা যায়। গ্রেফতার হয় অপরাধীরা। হতভাগ্য এই নারীর নাম শিমু (২০)। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় ফকিরাপুল এলাকায় থাকতেন। আর হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই তার স্বামী নাসির জেলে ছিলেন।

যেভাবে শুরু : ১০ মার্চ দুপুর সোয়া ১টার দিকে পুলিশ মতিঝিল থানার কালভার্ট রোড এলাকায় হোটেল উপবনের পাশে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি হাত ও একটি পায়ের কাটা অংশ উদ্ধার করে। এরপর পুলিশ অনুসন্ধানে নেমে একই দিন ফকিরাপুল ওয়াসা ভবনের দেয়ালের পাশ থেকে একটি বিচ্ছিন্ন পা উদ্ধার করে। আর সেখান থেকে একটু দূরে ময়লা-আবর্জনার ভিতর থেকে একটি হাত ও একটি বাহু উদ্ধার করে। শরীরের এসব বিচ্ছিন্ন অংশ ছিল বিকৃত-পোড়া।

পুলিশ জানায়, এসব এমনভাবে বিকৃত করা ছিল যে চেনার উপায় ছিল না। পুড়িয়ে বিকৃত করার কারণে মাথার চুল ছিল না। পুলিশ প্রথমে শরীরের সব অংশ পায়নি। তাই আরও অনুসন্ধান চালিয়ে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ১৯৩/২ ফকিরাপুলের আহসান মঞ্জিলের সাত তলার সিঁড়ির শেষ প্রান্তে আগুনে পোড়া মাথার আংশিক খুলি উদ্ধার করে। আর তা ছিল ছাই-কালি মাখানো।

যেভাবে হতভাগ্য নারীর লাশ শনাক্ত করা হলো : সেই দিনই পুলিশ শরীরের বিচ্ছিন্ন বিকৃত অংশগুলো এক করে মানুষের অবয়ব পায়। এরপর তা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। সেখানে ময়নাতদন্ত এবং ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে উদ্ধার করা শরীরের অঙ্গগুলো একই ব্যক্তির এবং তিনি একজন নারী। তার বয়সও জানা যায় আনুমানিক ২০ বছর। তবে তখনো তার নাম-পরিচয় জানা যায়নি। তদন্ত চলাকালে পুলিশ আরও অনুসন্ধান চালিয়ে ফকিরাপুলের ১৯৩/২ নম্বর বাড়ির দেয়ালে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ দেখতে পায়। সাত তলা এই বাড়ির সিঁড়ির শেষ প্রান্ত থেকেই এর আগে আংশিক মাথা উদ্ধার করা হয়। আর সেই রক্তের দাগ ধরে বাসার ছাদে উঠে পায় রক্তমাখা ছুরি, কেরোসিন তেলের বোতল এবং রক্ত মাখা শার্ট-প্যান্ট। পরে জানা যায় প্যান্ট-শার্ট যারা হত্যা করেছে তাদের। তবে পুলিশকে ছাদে উঠতে হয়েছে ছাদের দরজার তালা ভেঙে। বাড়ির মালিক মোবারক হোসেন মন্টিকে তখন পাওয়া যায়নি। চাবি নিয়ে আগেই সে লাপাত্তা। পুলিশ বাড়ির চার তলায় বসবাসরত মাদক ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন মন্টির স্ত্রীকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করে। আর জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা। জানা যায় হতভাগ্য নারীর নাম, পরিচয় ও ঠিকানা। আসামিরা যা বলল— ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মাদক ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন মন্টিসহ মোট ছয়জনকে আটক করে। তাদের মধ্যে চারজন আদালতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। তারা জানিয়েছে ৯ মার্চ গভীর রাতে মন্টির বাসার ছাদে বসে শিমুকে জবাই করা হয়। এর পর তাকে কেটে মোট ১০ টুকরা করা হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশ কেরোসিন তেল দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে বিকৃত করা হয়। আর সেই বিকৃত অংশগুলো নানা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয় যাতে তাকে আর শনাক্ত করা না যায়। হত্যাকাণ্ডের আগে শিমুকে ইয়াবা সেবন করানো হয়। এরপর তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মুখে কাগজ গুঁজে স্কচ টেপ দিয়ে মুখ আটকে দেওয়া হয় যাতে চিৎকার করতে না পারে। লাশ টুকরা টুকরা করা হয় খাইট্টার ওপর রেখে কুপিয়ে কুপিয়ে। মন্টির বাসার ছাদ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত ছুরি এবং লাশ টুকরো করার দাসহ আরও অনেক আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড : ডিবি জানায়, শিমুর স্বামী নাসিরও একজন মাদক ব্যবসায়ী। সে এই আটক আসামিদের সঙ্গেই মাদক ব্যবসা করত। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব্ব হলে হত্যাকাণ্ডের ৪/৫ দিন আগে তারা ইয়াবাসহ ধরিয়ে দিলে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিমু মাদক ব্যবসায়ী মন্টিসহ অন্যদের মাদক ব্যবসার কথা পুলিশকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। আর এ কারণেই শিমুর মুখ বন্ধ করতে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর চেষ্টা করা হয় হত্যাকাণ্ডের নিশানা মুছে ফেলতে। তিনি আরও জানান, শিমু তাদের পরিচিত এবং তারা শিমুকে ঘটনার রাতে ধরে নিয়ে বাসার ছাদে হত্যা করে। এর আগে তারা শিমুকে পালাক্রমে সবাই ধর্ষণ করে।

সর্বশেষ খবর