বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কিছু যুবকে গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতি কলুষিত

বিশ্বজিৎ হত্যার পূর্ণাঙ্গ রায়ে পর্যবেক্ষণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

কিছু যুবকে গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতি কলুষিত

দেশের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র রাজনীতিকে কিছু তরুণ ও যুবক মারাত্মকভাবে কলুষিত করছে বলে মন্তব্য করেছে হাই কোর্ট। আদালত বলেছে, ছাত্র রাজনীতির নামে এই যুবকরা সংঘবদ্ধভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। জাতি এ থেকে মুক্তি চায়।

পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ে হাই কোর্টের এ পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। গতকাল এ মামলার ৮০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এই মামলার আপিল, জেল আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে ৬ আগস্ট বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস এবং বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ রায় দেয়। রায়ে নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আট আসামির মধ্যে রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের সাজা বহাল রাখে হাই কোর্ট। এ ছাড়া চারজনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও বাকি দুজনকে খালাস দেওয়া হয়। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৩ আসামির মধ্যে যে দুজন আপিল করেছিলেন, তারা হাই কোর্টে খালাস পান।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, আধিপত্য ধরে রাখার প্রয়োজনে রাজনৈতিক নেতারা কখনো কখনো প্রকাশ্যে ও হিংস ভাবে শক্তি প্রদর্শন করেন। আর কিছু তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা নিজেদের স্বার্থে ছাত্রদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি যে, পরীক্ষায় নকল করার অনুমতি না দেওয়ায় ছাত্রদের হাতে শিক্ষকরা প্রহূত হন। অনেক ছাত্র ছাত্রাবাসে প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজ হাতে নেন এবং সাধারণ ছাত্রদের ভাড়ার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ দেন। অনেকে অতিরিক্ত ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণে বাধ্য করেন- যা খুবই ভয়ানক, বিপজ্জনক ও হতাশাজনক। জাতি এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।

রায়ে বলা হয়, যদিও প্রত্যাশা ছিল যে, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের দায়িত্বশীল জাতীয় নেতারা এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবেন। বিরোধী দলের কার্যক্রমকে দমন করতে যুবক ও ছাত্রদের আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত করা উচিত নয়। বিরোধী দলের হিংস  ও অপরাধমূলক কার্যক্রম বন্ধ করতে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, আমাদের সামনে প্রশ্ন হলো আসামিরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা। বিচারিক আদালত  যাদের সাজা দিয়েছে তা যথাযথ হয়েছে কিনা এবং তা ফৌজদারি আইনের নীতিসিদ্ধ কিনা। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মূলত শাকিল ও রাজন দায়ী। তারা উভয়েই অস্ত্র দিয়ে মারাত্মক আঘাত করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে একজন মানুষকে কুপিয়ে হত্যার এই ঘটনাটি ছিল একটি বর্বরতা। তাদের এই অপরাধের ধরন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং গোটা যুব সমাজের সঙ্গে মানানসই নয়। এ কারণে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহানুভূতি দেখাতে পারি না। এটা  কোনো পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয়। ওই অবরোধ কর্মসূচি প্রতিরোধের নির্দেশ যারা দিয়েছিল অনুসারীদের ফাঁসির কাষ্ঠের সামনে রেখে তারা দৃশ্যপটের বাইরে চলে গেছে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে রাজধানীর বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে বিশ্বজিেক প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ জন কর্মীর মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক। নিম্ন আদালতের রায়ের পর এ মামলার ডেথ রেফারেন্স হাই কোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামি পক্ষ আপিল ও জেল আপিল করে। পরে হাই কোর্টে আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়।

নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আটজনের মধ্যে শাকিল ও রাজনের সাজা বহাল রাখার পাশাপাশি মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন ও মীর মোহাম্মদ নূরে আলম লিমনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় হাই কোর্ট। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিয়াকে খালাস দেয় হাই কোর্ট। এ ছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত গোলাম মোস্তফা এবং এ এইচ এম কিবরিয়া হাই কোর্টে খালাস পান। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ১১ আসামির বিষয়ে হাই কোর্ট কোনো মন্তব্য করেনি।  এ মামলায় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান। আসামি পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, এস এম শাহজাহান, লুত্ফর রহমান মণ্ডল, সৈয়দ আলী মোকাররম, সৈয়দ শাহ আলম, আবদুস সালাম, মো. ইসা, সৈয়দ মাহমুদুল আহসান। পলাতক আসামিদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মোমতাজ বেগম।

সর্বশেষ খবর