বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি বিশাল গৌরবের

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টার স্মারকে অন্তর্ভুক্ত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার জন্য বিশাল গৌরবের। তিনি বলেন, ‘এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করায় আমি ইউনেস্কো এবং এর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দফতরে গত সোমবার ৭ মার্চের ভাষণকে স্মারকে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এক বিবৃতিতে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও তারা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে।’ তিনি বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তানিদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রুখে দাঁড়ান। তার নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম। বাঙালিদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার এবং নির্যাতন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম এক যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা ঘোষণার অপরাধে পাকিস্তান সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং পরে কুর্মিটোলায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখে। শুরু হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যক্রম। কিন্তু বাঙালিরা দমবার পাত্র নন। তারা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে আনেন। সামরিক জান্তাপ্রধান আইয়ুব খানের পতন হয়। আরেক সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পর ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। তারা উল্টো বাঙালিদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু করে।’

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভার ডাক দেন। সেদিনের জনসমুদ্রে তিনি বজ কণ্ঠে ঘোষণা দেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা।’ সরকারপ্রধান বলেন, ‘এ ভাষণে বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র মূর্ত হয়ে ওঠে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আবশ্যকতা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল এ ভাষণের মূল লক্ষ্য। শত্রুর মোকাবিলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো”। স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে ৭ মার্চের এই ভাষণ গোটা জাতিকে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর থেকেই পূর্ব বাংলার নিয়ন্ত্রণভার বাংলার মানুষের হাতে চলে যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে দেশ। কিছু সেনানিবাস ছাড়া দেশের অন্য কোথাও পাকিস্তানি শাসনের কোনো নিদর্শন ছিল না। জাতির পিতার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।’ তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চের কালরাতে অতর্কিতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে তিনি অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। সামরিক আদালতের বিচারে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।’ জাতির পিতার নির্দেশে পরিচালিত নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময়ের বজ কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র।’ তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালি জাতির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে একসূত্রে গ্রথিত করেন। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণে দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময়ের বজ কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র, যার আবেদন আজও অম্লান। প্রতিনিয়ত এ ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে এবং অনাদিকাল ধরে অনুপ্রাণিত করে যেতে থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। এ ভাষণ বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে। লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের আড়াই হাজার বছরের গণজাগরণ ও উদ্দীপনামূলক বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা “উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস : দ্য স্পিচেস দ্যাট ইনসপায়ার্ড হিস্ট্রি” গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে। বিশ্বের ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ইউনেস্কোর বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টার স্মারকে অন্তর্ভুক্তি এই ধারাবাহিকতায় আরেকটি মাইলফলক।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসকেরা এবং পরবর্তীকালে বিএনপি-জামায়াত জোট জাতির পিতার এই ভাষণকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ ছিল এই ভাষণের প্রচার। কিন্তু সাধারণ মানুষের হৃদয় থেকে কোনো দিনই মুছে যায়নি এই ভাষণ।’ প্রধানমন্ত্রী এ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন নেছাসহ ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণকারী পরিবারের সব সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন।

সর্বশেষ খবর