রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গো য়ে ন্দা কা হি নী ৬৫

খুনে অর্ডারি ছুরি

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনে অর্ডারি ছুরি

হাসিনা বেগমের শরীর খারাপ। নানা ধরনের অসুখে পেয়েছে তাকে। তার মেয়ে মোহসিনা রব্বানী মেনকা মায়ের দেখাশোনা করছেন। তিনি ইডেন কলেজের ছাত্রী। দুপুরের পর হাসিনা বেগম খেয়ে দেয়ে নিজের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। কলেজ থেকে ফিরে মেয়ে মেনকা তার নিজ রুমে বই পড়ছিলেন। হঠাৎ মেনকার আর্তচিৎকারে হাসিনা বেগমের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি উঠে  দেখেন, বসার ঘর খালি। মেনকার ঘরের দরজা বন্ধ। ততক্ষণে আর্তনাদ থেমে গেছে। তিনি ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে তা খুলতে বলেন। কিন্তু ভিতরে তখন ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে এক যুবক। তিনি শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘মেনকা আর  নেই। আমি মাইরা ফালাইছি। আপনি পুলিশ ডাকেন। পুলিশ না আইলে আমি দরজা খুলব না।’

২০১০ সালের ১৫ জুলাইয়ের বিকালে খুন হন ইডেন কলেজের ছাত্রী মেনকা। মিরপুর মধ্য পাইকপাড়ার ২৯/২/এ নম্বরের বাসায় তাকে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খুনির নাম কবির। তিনি মেনকার দুসম্পর্কের মামা। খবর পেয়ে পুলিশ আসে। কবিরকে গ্রেফতার করে পুলিশ।  পুলিশের জেরার মুখে কবির জানিয়েছেন, ‘মেনকা আমার সঙ্গে বেইমানি করেছে। আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু সে আমার কোনো কথাই শোনে না। তাই, ফরিদপুরে আমি একটি ছোরা বানাতে অর্ডার দেই। ছোরার নকশা আমি নিজেই তৈরি করে দেই। সেই ছোরা নিয়ে চলে আসি ঢাকায়।’ পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েই এ ঘটনা ঘটিয়েছেন কবির। তাকে ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ব্যবহৃত রক্তাক্ত ছুরিটি। এরপর হাসিনা চিৎকার শুরু করলে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন। মিরপুর থানায় ফোন করা হয়। পুলিশ আসার পর দরজা খুলে দেন কবির। ততক্ষণে মেনকা আর বেঁচে নেই। ঘরের এক কোনায় পড়ে ছিল তার রক্তাক্ত নিথর দেহ। ঘটনাস্থলে প্রথমে পৌঁছানো পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, তিনি পুলিশের লোক হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পর কবির দরজা খোলেন। উপস্থিত উত্তেজিত লোকজন তখন তার ওপর হামলে পড়েন। তবে পুলিশ তাকে সরিয়ে ফেলে। প্রতিবেশীরা বলেছে, মেনকার ঘরের দরজা লোহার তৈরি হওয়ায় তা ভাঙা সম্ভব হয়নি।

অনুতাপ ছিল না খুনির : খুনের পর একদম নির্বিকার ছিলেন কবির। মিরপুর থানায়ও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যায়নি। থানায় তিনি বলেছিলেন, ‘এখনো এ কাজের জন্য আমার খারাপ লাগতেছে না। যা করছি, ভালোই করছি। ও (মেনকা) আমার সঙ্গে বেইমানি করছে।’

কবির দাবি করেছেন, তার সঙ্গে একসময় মেনকার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে মেনকা তাকে এড়িয়ে চলছিলেন। পুলিশের তদন্তে জানা যায়, খুনের এক সপ্তাহ আগে কবির এ খুনের পরিকল্পনা করেন। এ জন্য ফরিদপুর থেকে অর্ডার দিয়ে ছুরি তৈরি করেন। সিঙ্গাপুর যাওয়ার মিথ্যা কথা বলে  দেখা করতে মেনকাদের বাড়িতে যান। হাতে থাকা ট্রাভেল ব্যাগের ভিতরেই ছিল ছুরি। মেনকার ঘরে গিয়ে মেনকাকে বিয়ের চাপ দিলে একপর্যায়ে একজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়েছে বলে জানায় মেনকা। এতে ক্ষেপে গিয়ে তিনি  মেনকাকে সমানে ছুরি মারতে থাকেন। কবিরের দাবি, ২০০৪ সাল থেকে মেনকার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। ২০০৭ সালে কবির মালয়েশিয়ায় যান। তার দাবি, ২০০৯ সালে ফেরার পর আবারও তাদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। কিন্তু কিছুদিন থেকে সম্পর্ক রাখতে অস্বীকার করতে থাকেন মেনকা। মেনকার স্বজনরা বলেছেন, তাদের জানা মতে, কবিরের সঙ্গে মেনকার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কেউ কখনো এ রকম ধারণাও করেননি, এখনো বিশ্বাস করেন না।

বিচার : ইডেন কলেজের ছাত্রী মহসিনা রাব্বানী মেনকা হত্যা মামলার আসামি তারিকুজ্জামান কবিরকে ফাঁসি দিয়েছে আদালত। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১০ সালের ১৫ জুলাই রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ার বাসায়  মেনকাকে হত্যা করেন কবির। হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক মো. রেজাউল ইসলাম আসামির উপস্থিতিতে রায় দেন। রায় শুনে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কবিরের  কোনো ভাবান্তর দেখা না গেলেও কান্নায় ভেঙে পড়েন আদালতে উপস্থিত মেনকার বাবা লুেফ রব্বানী এবং মা হাসিনা রব্বানী। হত্যাকাণ্ডের পর মেনকার বাবা মিরপুর মডেল থানায় কবিরকে আসামি করে মামলা করেন। ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। দণ্ডিত কবির মেনকার খালা জেসমিনের দেবর। তাদের বাড়ি ফরিদপুরে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর