সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গারা ফিরবে কবে

জুলকার নাইন

দশ লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে চলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু  রোহিঙ্গাদের আগমন এখনো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ চায় শান্তিপূর্ণভাবে সব রোহিঙ্গার মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন। কিন্তু সেটা কবে সম্ভব হবে, তা জানে না কেউ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চেষ্টা চলছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। এতে কিছুটা সময় লাগেই। সেই সঙ্গে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক প্রবল চাপ তৈরি। এক্ষেত্রে শক্তিশালী কিছু রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের অনুকূলে আনার জোর চেষ্টা চলছে। এটাও সময় সাপেক্ষ। তবে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কত দিন এই ভার বহন করবে এবং নতুন-পুরনো সব রোহিঙ্গা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া কী হবে? কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমার যদি তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিক হয়, তবে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নও পরিস্থিতি উত্তরণে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। অবশ্য বিশ্লেষকদের একটি অংশের ধারণা, কেউ কাউকে এমনিতেই কিছু দেয় না। তাই রোহিঙ্গাদের নিজেদেরই তাদের অধিকার অর্জন করে নিতে হবে। দীর্ঘদিন মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়- সে দেশের সরকার এমন দাবি করলে তাদের প্রত্যাবাসনের উপায় আছে। কারণ, মিয়ানমারের আইনে দেশটিতে তিন ধরনের নাগরিকত্ব আছে। সেটা হচ্ছে, নাগরিক, সহযোগী নাগরিক এবং আবাসিক সুবিধাভোগকারী নাগরিক। ১৮২৩ সালের আগে যেসব জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে ছিল, তাদেরই জাতি বা সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে দেশটি। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা নেই। তবে জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় ছাড়াই তাদের নাগরিক হওয়ার সুযোগ আছে। তাই তাদের নাগরিকত্ব আইনটি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালের আইনের বিধিনিষেধ সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ আছে। সেটি কাজে লাগাতে হবে। সুযোগ যে আছে তার প্রমাণ, এদের ১৫ বছরের মেয়াদের জন্য একটি নাগরিকত্ব ছিল। যাদের মধ্যে ২০১০ সালের নির্বাচনে পাঁচজন পার্লামেন্টের এমপিও হয়েছিলেন। এদের এখন নাগরিকত্ব শেষ হয়েছে। তবে প্রয়োজন সদিচ্ছার। সদিচ্ছা থাকলে নিশ্চয়ই কোনো দেশ তার অধিবাসীদের অস্বীকার করতে পারে না।

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীও বলেন, ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিচয়পত্রই লাগবে এমন দাবি মিয়ানমার করতে পারে না। কারণ, এই নির্যাতনের পরিস্থিতিতে কি তারা কাগজপত্র নিয়ে আসতে পেরেছে? এটা কি করা সম্ভব? আর মিয়ানমার কি এদের কাগজপত্র দিয়েছে? তবে আন্তরিকতা থাকলে ফেরানোর ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর হেডম্যানরাই গ্রামের অধিবাসীদের পরিচয় নিশ্চিতের কাজ করে দিতে পারে। হেডম্যানের সার্টিফিকেটও হতে পারে প্রত্যাবর্তনের সার্টিফিকেট। মিয়ানমার থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইরাওয়ার্দির সম্পাদক কিয়াও  জোয়া মোয়ের সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, কঠিন চাপে পড়লে  রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবে মিয়ানমার। তবে এদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করার সক্ষমতা না থাকায় তারা এই প্রক্রিয়া শুরু করতে সময় নেবে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, শরণার্থী প্রত্যাবাসন নিয়ে যতক্ষণ দুদেশের মধ্যে কোনো চুক্তি না হচ্ছে, ততক্ষণ এই ইস্যুতে কোনো কাজই শুরু করা যাবে না। তিনি বলেন, জাতিসংঘ শরণার্থী রোহিঙ্গাদেও যে সংখ্যা উল্লেখ করছে এবং মিয়ানমারের প্রশাসনের কাছে যে হিসাব আছে তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ফলে এটাও এই কার্যক্রম শুরুও পেছনে একটি বাধা হিসেবে কাজ করছে। আমি মনে করি, এই মানুষগুলোর পরিচয় কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, সেটা নিয়েও কর্মকর্তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা আছে। কারণ বাংলাদেশ অংশে লাখ লাখ মানুষ আছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের দৃঢ় কোনো অবস্থান ছাড়া জাতিসংঘের অন্য কোনো মহলে আলোচনায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না। একমাত্র নিরাপত্তা পরিষদ যদি একটি প্রস্তাব পাস করে বলে যে, এই লোকগুলোকে আমরা প্রটেকশন দেব, তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাব।  রোহিঙ্গাদের জন্য একটা সেফ জোন বানিয়ে দেব। তাহলেই কেবল কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিশ্বের দেশে দেশে শান্তি মিশনে সেনাবাহিনীরা এ কাজই করে। এমন ব্যবস্থা নেওয়ার আগে কোনো আন্তর্জাতিক আলোচনা বা চাপই আসলে কোনো মূল্য রাখে না। এসব থেকে তেমন কোনো ফলও আশা করা যায় না। তিনি বলেন, বাইরের দেশের এত নাগরিককে দিনের পর  দিন বাংলাদেশে রাখা নিশ্চয় সম্ভব নয়। তারপরও এদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য তো একটা আবাসস্থল প্রয়োজন। তাহলে সেই আবাসস্থল রোহিঙ্গাদের নিজেরদেরই ঠিক করে নিতে হবে। কী পদ্ধতিতে এটা হতে পারে জানতে চাইলে সাবেক এই পদস্থ সেনা কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ব ইতিহাসে যুগে যুগে নানা ধরনের উদাহরণ আছে। সেখান থেকেই রোহিঙ্গাদের নিজেদের পথ নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। তিনি বলেন, কারও অধিকার কেউ হাত পেতে পায় না। অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। মিয়ানমারে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর দুর্ভোগ  নেমে আসে। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন বার্মা প্রথমবারের মতো নাগরিকদের নিবন্ধন করতে শুরু করে এবং রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি’ বলে নাগরিকত্ব নিবন্ধন থেকে বাদ দেয়। ১৯৭৮ সালের মে মাস নাগাদ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘নাগামান’ (ড্রাগন রাজা) অভিযানের ফলে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পরে তাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। এরপর ১৯৮২ সালে মিয়ানমার জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নাগরিক আইন সংশোধন করে। রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। পরে ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ, জোরপূর্বক শ্রম এবং ধর্মীয় নিপীড়নের মাত্রা সীমা ছাড়ায় প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হন। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯২ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা ফেরত নিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার সরকার। কিন্তু ২০০৫ সালে এসে হঠাৎ করেই এক তরফা বন্ধ করে দেওয়া হয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া। ২০১২ সালে আরেক দফায় নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে গত ২০১৬ এর অক্টোবরে প্রায় ৭০ হাজার এবং গত ২৬ আগস্টের পর থেকে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ অং সান সু চি বলেছেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। যদিও এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে প্রত্যাশিত আচরণ করেনি মিয়ানমার। বাংলাদেশের প্রস্তাবে তেমন কোনো সাড়াও পাওয়া যায়নি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর