রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আতঙ্কের নাম শ্যামপুর

শোচনীয় পুরান ঢাকা - ২

মাহবুব মমতাজী

আতঙ্কের নাম শ্যামপুর

মাদক আর সন্ত্রাসীদের আনাগোনায় পুরান ঢাকার শ্যামপুর অনেকটা আতঙ্কের এলাকায় পরিণত হয়েছে। যে কারণে কদমতলীর নামা শ্যামপুর আর ওয়াসা পুকুরপাড় এলাকায় অপরিচিত মানুষের জটলা দেখলেই বেজে ওঠে সাইরেন। লাঠি আর বাঁশি হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসেন আশপাশের  মানুষ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মাদক আর সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ এলাকার সাধারণ মানুষ নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাইরেন বাজিয়ে হাতে তুলে নিয়েছেন লাঠি আর বাঁশি। সরেজমিন জানা যায়, শ্যামপুর-কদমতলীর ওই এলাকাটি আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। দিনদুপুরে চলে মাদকের রমরমা ব্যবসা। রাতে ওয়াসা এলাকা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। এলাকায় মাঝে-মধ্যে পড়ে থাকে অজ্ঞাত মানুষের লাশ। কখনো কখনো শোনা যায় গোলাগুলির শব্দ। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওয়াসা এলাকাটি মূলত এক ধরনের ‘মাদকের হাট’। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিল্লাল হোসেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল এলাকাটি। তার নানা অপকর্মে সহযোগিতা করে আসছিলেন কিছু পুলিশ-আনসারের অসাধু সদস্য। এ সিন্ডিকেটে জড়িত আছেন স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা। গত ৭ নভেম্বর প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত বিল্লালের লাশ উদ্ধার করে কদমতলী থানা পুলিশ। তবে তার অনুসারীরা এখনো এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছে। জানা গেছে, ৭০০ একর এলাকাজুড়ে শ্যামপুর ওয়াসা এলাকার অবস্থান। এলাকাটিতে বিশাল আকারের ২০টি পুকুর রয়েছে। ঢাকার বড় একটা অংশের পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য এসে পড়ে ওইসব পুকুরে। ওয়াসার বিস্তীর্ণ এলাকাটি নারায়ণগঞ্জের পাগলা ও ফতুল্লার সীমানাঘেঁষা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, কদমতলীর কুখ্যাত সন্ত্রাসী পলাতক আমির হোসেন ওরফে কাইল্যা আমির ও নিহত বিল্লাল ডাকাতের সন্ত্রাসী গ্রুপ মিলেমিশে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ওয়াসা এলাকায় অস্ত্রের চালানের হাতবদল করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলও পাচার করে। টেকনাফ ও চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবার চালান আসে ওয়াসা পুকুর এলাকায়। এ ছাড়া রাতের অন্ধকারে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে নৌকায় করে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন লঞ্চে তুলে দেওয়া হয় মাদক দ্রব্য। বিল্লালের ভাই ইমরানের পক্ষ নিয়ে মাদক স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণ করে লিটন, জালাল, বন্দুক সেলিম ও ফারুক। পুলিশ অভিযান চালাতে গেলে সন্ত্রাসীরা রসুলপুর হয়ে ফতুল্লার দিকে পালিয়ে যায়। তারা গুলি ও চোখে উচ্চমাত্রার টর্চলাইট মেরে সহজেই পালাতে পারে। এমনকি প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এলাকার বস্তির শিশুদের দিয়ে মাদক দ্রব্য আনা-নেওয়া করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। অল্প বয়সে উপার্জনে জড়িয়ে পড়া ওইসব শিশুই এক সময় ছিনতাই, চুরি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ফরিদাবাদ এলাকার সালাম নামের এক দোকানদার জানান, গত বছর কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে পাপ্পু নামের এক যুবকের ছুরিকাঘাতে নিহত হন আরেক যুবক শাহেদ। পাপ্পুর বেড়ে ওঠা ঢালকানগর বস্তিতে। পড়ালেখা ছেড়ে টাকা রোজগারের দিকে অল্প বয়সেই ঝুঁকে পড়ে সে। শাহেদ নিহতের পরই পুলিশ গ্রেফতার করে পাপ্পুকে। জানা যায়, ফরিদাবাদের বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনির চারদিক দিয়ে ঢালকানগর, গ্লাস ফ্যাক্টরি, হরিচরণ রায় রোডের দুই পাশে গড়ে উঠেছে খুপরি ঘর। এসব ঘর নিম্ন আয়ের মানুষের আবাস। ব্যাংক কলোনির আইজি গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের বামে চোখে পড়বে লোহার গেট। তার ওপারে স্বল্পপরিসর নিয়ে গড়ে উঠেছে বস্তি। এখানে ৩০-৩৫টি ঘর। এ বস্তির প্রবেশমুখের তিনটি পয়েন্টেই তিন যুবক প্রায় সময়ই দাঁড়িয়ে থাকে। যাদের কাজ হলো অপরিচিত মুখের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা। কিছু কিছু ঘরের বাইরের অংশে বস্তির চেহারা কিন্তু ভিতরে রয়েছে বিলাসী আসবাবপত্র। এ ধরনের ঘরগুলোয় চলে মাদকের আড্ডা, বেচাকেনা। এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় শিশুদের। কারণ শিশুরা সন্দেহের বাইরে থাকে। এ বস্তি থেকেই মাদক সরবরাহ করা হয় গেন্ডারিয়ার ঘুণ্ডিঘর এলাকায়। এ রুটের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে হরিচরণ রায় রোডের এক ভিক্ষুক, যার কাজ সারা দিন সেখানে বসে ভিক্ষা করা। আর মাদকসেবীদের মাদকের আখড়া চেনানো। কখনো নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছায় মাদক পার্সেল। কথা হয় আকবর (ছদ্মনাম) নামে বস্তির এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি জানান, এ বস্তিটি গেন্ডারিয়া ও শ্যামপুর দুই থানার মধ্যে পড়েছে। বস্তিতে অবাধে মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইয়াবা পাওয়া যায়। এসব কাজে কোনো ঝামেলা যাতে না হয় সে জন্য শ্যামপুর ও গেন্ডারিয়া থানায় প্রতিদিনই প্রায় তিন লাখ টাকার ঘুষ দিতে হয়। এ অভিযোগ অস্বীকার করেন গেন্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান। জানতে চাইলে কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল জলিল জানান, আমিরকে ধরতে আমরা সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। তবে ওয়াসা পুকুরপাড় এলাকায় মাদকের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর