রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বাড্ডায় বাবা-মেয়ে খুন

পরস্পরকে দোষ দিচ্ছেন খুনিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর বাড্ডায় জোড়া খুনের ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে খুনিরা। একই সঙ্গে তারা খুনে নিজেদের সরাসরি জড়ানোর বিষয়ে পরস্পরকে দোষ দিয়েছে। জামিল ও তার সাত বছরের মেয়ে নুসরাতকে নির্মমভাবে খুনের পরই আরজিনা, শাহীন, মাসুমা ও খোয়াজকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের মধ্যে শাহীনের স্ত্রী মাসুমা ছাড়া প্রত্যেকের জবানবন্দি আদালতে  রেকর্ড করে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়। বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, খুনে মাসুমার ভূমিকা এখনো পরিষ্কার নয়। সেটি নিয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। বাবা-মেয়ে হত্যাকাণ্ডটি ‘ডাকাতি’ হিসেবে প্রমাণ করতে খুনের পর রোমহর্ষক ও পৈশাচিক কাণ্ড ঘটায় খুনিরা। আদালত সূত্র জানায়, চার দিনের রিমান্ড শেষে বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যব্রত বিশ্বাসের আদালতে আসামি শাহীন মল্লিকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শাহীন বলেন, ‘আরজিনা এবং আমি পাশাপাশি থাকার কারণে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথমে আরজিনা আমাকে প্রস্তাব দেয়। একপর্যায়ে আরজিনা বাসা থেকে চলে আসে। দুই মাস পর সে আবার জামিলের সংসারে ফিরে যায়। আরজিনার পরিবার আমার আর আরজিনার সম্পর্কটা মেনে নিতে পারেনি। এ কারণে আরজিনা আমাকে বলে, সংসার করতে চাইলে আগে জামিলকে খুন করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আমার এক বান্ধবীকে দিয়ে একটি ফার্মেসি থেকে ঘুমের ওষুধ এনে আরজিনাকে দিই। আরজিনা সেই ঘুমের ওষুধ করলা ভাজির সঙ্গে মিশিয়ে জামিলকে খাওয়ায়। জামিল ঘুমিয়ে পড়লে আমি তাকে কাঠ দিয়ে মাথায় আঘাত করি। জামিলকে মারার দৃশ্য নুসরাত দেখে ফেলায় তাকে বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলি। আমি তাদের মারতে চাইনি। হঠাৎ একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেছে।’ পুলিশ জানায়, বাবা-মেয়ে খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিবার খোয়াজ আলীকে গ্রেফতার করা হয়। রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার আদালতে খোয়াজের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে খোয়াজ বলেন, খুনের বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। শাহীনের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের পরিচয়। সেই সুবাদে শাহীন তাকে জানান, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ডিস্টার্ব করে। তাকে শাস্তি দিতে হবে। শাহীন তাকে ফোনে ডেকে নিয়ে যান জামিলের ঘরে আর তাকে জামিলের মুখে চাপা দিতে বলেন। কথা অনুযায়ী তিনি বালিশচাপা দিলে জেগে ওঠেন জামিল। পরে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যান। এর আগে ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরীর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আরজিনা। সেখানে তিনি দাবি করেন, স্বামী জামিলকে খুন করতে পারলেই প্রেমিক শাহীনকে বিয়ে করা সম্ভব। এই চিন্তা থেকেই তিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রেমিকের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে জামিলকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর স্ট্রোকে মৃত্যুর খবর প্রচার করবেন তারা। ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে বিছানায় জামিল দুই সন্তানকে নিয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলেন। তখন টিভি দেখতে আসেন বাসায় সাবলেটে থাকা প্রেমিক শাহীন। একপর্যায়ে জামিল ঘুমিয়ে পড়েন। বাচ্চারাও ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর শাহীন তার এক বন্ধু খোয়াজ আলীকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘কাজ হয়ে গেছে, চলে আয়।’ এ কথা বলেই শাহীন ঘর থেকে বের হয়ে যান। আরজিনাও ঘরের দরজার ভিতর থেকে ছিটকিনি না আটকিয়ে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে শাহীন ঘরে ঢোকেন। তিনি জামিলের বুকের ওপর উঠে বসেন। শাহীন ও তার বন্ধু খোয়াজ আলী বালিশ দিয়ে জামিলের নাক-মুখ চেপে ধরেন। এ সময় জামিল জেগে উঠে বসে পড়েন। তখন খোয়াজ দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে চলে যান। জামিল তখন উঠে বসে বলেন, ‘ওরা কে? ঘরে ঢুকল কীভাবে?’ তখন শাহীন দৌড়ে বাইরে গিয়ে একটি কাঠের টুকরা নিয়ে ফিরে আসেন। এর মধ্যে জামিল বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় শাহীন কাঠের টুকরা দিয়ে জামিলের মাথায় আঘাত করেন। জামিল চিৎকার দিয়ে বিছানায় পড়ে যান। এ সময় মেয়ে নুসরাত জেগে উঠে চিৎকার দেয়। তখনো জামিল রক্তাক্ত অবস্থায় বিছানায় ঢুলছিলেন। শাহীন আবার তার মাথায় কাঠের টুকরা দিয়ে বাড়ি দেন। পরে গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে জামিলের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। কিন্তু বালিশচাপা দিতে গিয়ে জেগে ওঠায় জামিলকে আঘাত করে হত্যা এবং হত্যাকাণ্ড দেখে ফেলায় শিশু নুসরাতকে হত্যা করা হয়। ২ নভেম্বর রাজধানীর উত্তর বাড্ডার ময়নার বাগের একটি বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় জামিল শেখ (৩৮) ও তার মেয়ে নুসরাতের (৭) লাশ। ওই ঘটনায় বিকালেই নিহত জামিল শেখের ভাই মো. শামীম শেখ বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রথমে নিহত জামিলের স্ত্রী আরজিনা বেগম (৩০) ও সাবলেটের ভাড়াটে শাহীন মল্লিককে (২৬) আসামি করা হয়।

সর্বশেষ খবর