সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আট ভেলায় ঢুকল আরও কয়েকশ রোহিঙ্গা

ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে

উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে খোলা আকাশের নিচে দুই দিন অর্ধাহার-অনাহারে কাটিয়ে অবশেষে গতকাল বিকালে বালুখালী ও শফিউল্লাহকাটা ক্যাম্পে ঠাঁই পেয়েছে সহসাধিক রোহিঙ্গা।

জানা গেছে, গত শনিবার ভোর থেকে মিয়ানমারের কুয়াংছিদং সীমান্ত হয়ে উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে জড়ো হয় প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে ওই দিন কেউ কেউ দিনের আলোতে উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে পারলেও সন্ধ্যা হয়ে আসায় যেতে পারেনি সহস্রাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। এদের খোলা আকাশের নিচে অনাহারে-অর্ধাহারে দুই দিন ও এক রাত কাটাতে হয়েছে। এখানেই নাফ নদের তীরে দুই দিনে দুই রোহিঙ্গা নারী জন্ম দেন দুই শিশু। এদের মধ্যে এক প্রসূতি মহিলাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় গতকাল আন্তর্জাতিক রেডক্রসের স্বাস্থ্যকর্মীরা উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালে রেফার করেন। অন্যদিকে গতকালও টেকনাফের সাবরাং নয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে ভেলায় চড়ে ৩৪৬ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের বিজিবি হেফাজতে রেখে প্রাথমিকভাবে মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ভেলায় চড়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি। আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, নাফ নদের শাখা নদের বেড়িবাঁধে কোনো পরিবার একটি পলিথিন বা একটি কম্বল, আবার কোনো পরিবার একটি ত্রিপল বা এক টুকরা কাপড়কে শামিয়ানার মতো টাঙিয়ে তার নিচেই অপেক্ষা করছিল। এখানে আসার পর থেকে তাদের কপালে জোটেনি খাদ্য। শুধু একটি করে কলা ও পানির বোতল জুটেছে দুই দিনে। পায়ে হেঁটে ওপার থেকে আসা এসব রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে বেশ কয়েক বেলা না খেয়েই পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছে। শিশুদের অনেকেই ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত বলে জানান রেডক্রসের এক কর্মী। উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা আত্মীয়-স্বজনরা শুকনো ও রান্না করা খাবার নিয়ে সীমান্তে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে গেলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে গতকাল বেলা ৩টার দিকে জাতিসংঘের রিফিউজি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআর এর পক্ষ থেকে নতুন আসা এসব রোহিঙ্গার মাঝে খাবার দিতে অনুমতি চাইলে অনুমোদন দেয় বিজিবি। এর আগে অন্য কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে তেমন সুযোগ দেওয়া হয়নি। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে একটি ত্রিপলের নিচে কথা হয় সদ্য সন্তান প্রসব করা রোহিঙ্গা নারী আরেফা বেগমের (৩৫) সঙ্গে। শনিবার সকাল ১০টায় ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে আরেফা বেগম চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, ‘বুছিদংয়ের উলাফে থেকে স্বামীর সঙ্গে ৮ দিন আগে ঘর থেকে বের হয়েছি। পাড়ার আরও ২০-২৫ ঘরের লোকজন সঙ্গে ছিল। কী যে কষ্ট হয়েছে হেঁটে আসতে, তা আমার মতো পরিস্থিতিতে না পড়লে কেউ বুঝবে না। অনেকবার মনে হয়েছে—এই বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এখনো বেঁচে আছি।’ একটু দূরেই বেড়িবাঁধে বসা তার স্বামী মোহাম্মদ হোসেন (৫০) বলেন, ‘এটাই আমাদের প্রথম সন্তান। দীর্ঘদিন কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনজনকে দত্তক হিসেবে পালন করেছিলাম। সেগুলোও বেঁচে নেই এখন। তাই গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে ওপারে আর থাকার কোনো সাহস পাচ্ছিলাম না। মিয়ানমারের পুলিশ ও লুঠকারীরা এপাড়া থেকে ওপাড়া যাওয়ারও সুযোগ দিচ্ছিল না। তাই স্ত্রীর গর্ভের ধনকে বাঁচানোর জন্য এখানে চলে এসেছি।’ এদিকে সীমান্তের বেড়িবাঁধেই খোঁজ নিয়ে দেখা মেলে গতকাল সকালে সন্তান জন্ম দেওয়া ছেনোয়ারা বেগমের বড় বোন জাহানারা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে রক্তপাত বন্ধ না হওয়ায় তার বোনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তারা বুছিদংয়ের কেন্নারেখোয়া গ্রাম থেকে চার পরিবারের ১৭ জন একসঙ্গে বের হওয়ার পর ১৭ দিন পায়ে হেঁটে শুক্রবার এই সীমান্তে আসেন। আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের এই সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু দুই দিন এক রাত খোলা আকাশের নিচে কাটিয়ে গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ক্যাম্পে যাওয়ার অনুমতি পায়। বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নতুন করে আসা এই রোহিঙ্গাদের সীমান্তে আটকে রাখা হয়। তবে যাচাই-বাছাই ও তল্লাশি শেষে বিকালে তাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এদিকে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টেকনাফের সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে মোট ৮টি ভেলায় চড়ে ৩৪৬ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু অনুপ্রবেশ করেছে। এর বাইরে আরও শদুয়েক রোহিঙ্গা মাছ ধরার ট্রলারে করে টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে অনুপ্রবেশ করে বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাঈন উদ্দিন খান জানান, গতকাল আসা রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করে প্রাথমিকভাবে মানবিক সহায়তা দিয়ে বিজিবি তাদের হেফাজতে রেখেছে। তাদের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

সর্বশেষ খবর