বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
মৌলভীবাজারের পর্যটন শিল্প - ২

উদ্যোগ গ্রহণ করলেই হতে পারে রাজস্ব এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র

দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, শ্রীমঙ্গল

মৌলভীবাজারের পর্যটনশিল্পের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেই এ অঞ্চল হতে পারে রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। হতে পারে মানুষের কর্মসংস্থানেরও উর্বর স্থান। পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকরী কর্মকৌশল প্রণয়ন, পরিকল্পিত উদ্যোগ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সফল বিনিয়োগের মাধ্যমে জেলার পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে এ অঞ্চলে স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরি হবে। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। এতে শুধু এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, দেশের অর্থনীতিও উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হবে। প্রসঙ্গত, এ জেলার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে বিবেচনা করে ২০০৮ সালে ১ জুলাই ‘এসো বাংলাদেশ গড়ি’ রোড শো উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান শফিক আলম মেহেদী মৌলভীবাজারকে পর্যটন জেলা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসন থেকে বেসাময়িক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ‘মৌলভীবাজার জেলাকে পর্যটন জেলা হিসেবে উন্নীতকরণ’ নামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মৌলভীবাজারকে পর্যটন জেলা হিসেবে গড়ে তুলতে সমন্বিত কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ও ইকো পার্ক উন্নয়নের মধ্যেই আটকে আছে জেলার পর্যটনের বিকাশ। যদিও পাহাড়-টিলা, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝরনা, নদ-নদী পরিবেষ্টিত ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এ জেলা ইকো-ট্যুরিজমের জন্য খুবই উপযোগী। যে কারণে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ভ্রমণে আসেন। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে শুধু লাউয়াছড়াই ভ্রমণ করেছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ৬৬ জন পর্যটক। কিন্তু পর্যটকদের চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন, অবকাঠামো, বিনোদন, পথনির্দেশনা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই এখান থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে যান। এখানে পর্যটকদের জন্য নেই কোনো তথ্য কেন্দ্রও। ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এসে রিকশা চালক, গাড়িচালক, নতুবা পথচারীদের নিকট থেকে পর্যটন সংশ্লিষ্ট তথ্য জানার চেষ্টা করেন। এতে করে দুর্ভোগে পড়তে হয় বিদেশি পর্যটকদের।

স্থানীয় ট্যুর গাইড শ্যালম দেব বর্মা বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় সরকারিভাবে একটি পর্যটন মোটেলের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু ফিনলে টি কোম্পানি মামলা দিয়ে ওই পর্যটন মোটেলের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। তবে জেলায় পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকলেও কিছু উদ্যোগী মানুষ এ শিল্পটির বিকাশ ঘটাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক রিসোর্ট, কটেজ, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে ফাইভ স্টার মানের হোটেল গ্রান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ এবং দোসাই রিসোর্ট, টি হেভেন, লেমন গার্ডেন রিসোর্ট। 

বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে উদ্যোগ নিলে ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ লাখ ২৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ শতাংশ। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে বছরে দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। এরইমধ্যে পর্যটন শিল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির দিক থেকেও সর্ববৃহত খাত হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।  বাংলাদেশ যদি পর্যটন শিল্পের এই বিশ্ব বাজার ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি।

শ্রীমঙ্গল ট্যুর গাইড কমিউনিটির সভাপতি খালেদ হোসেন বলেন, প্রকৃতি এ জেলাকে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। এখন শুধু সমন্বিত উদ্যোগে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এ শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। আমাদের দেশের পর্যটকরা যাতে বিদেশমুখী না হন, তার জন্য বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলেয়ে দেশের সব পর্যটন স্থানগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি আর আধুনিকায়ন করতে হবে, সব ধরনের সুযোগসুবিধা সৃষ্টি করতে হবে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। এতেকরে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যাও বাড়বে। 

মৌলভীবাজারের পর্যটন উন্নয়ন কর্মী হাসনাত কামাল বলেন, জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির দিক থেকে মৌলভীবাজার হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে খুবই সমৃদ্ধ একটি স্থান। হাওর, পাহাড়, সমতলভূমি, জলাশয়, চা বাগান— এসব কিছুর সমন্বয়েই এই জেলা। মৌলভীবাজারের মতো এত দর্শনীয় স্থান দেশের আর কোথাও নেই। আমরা যদি প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে পরিকল্পনা মাফিক কাজে লাগাতে পারি, তাহলে পর্যটনশিল্পে মৌলভীবাজার দক্ষিণ এশিয়ার হার্টে পরিণত হবে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এগুলোর  বেন্ডিং করতে পারলে এ শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এতে বছরে এ জেলার পর্যটন থেকে আনুমানিক পঞ্চাশ থেকে একশ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া পাঁচ থেকে দশ হাজার যুবকের কর্মসংস্থানও হবে।

ইন্ডাস্ট্রি স্কিল কাউন্সিল ফর ট্যুরিজমের প্রধান নির্বাহী মহিউদ্দিন হেলাল বলেন, পর্যটন শিল্প এখন আর শুধু ঘুড়ে বেড়ানো নয়। এটা এখন উন্নয়নেরও একটি মাধ্যম। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন, প্রকৃতি সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, হাওর উন্নয়নসহ মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। একটি এলাকায় যত বেশি পর্যটক যাবেন, সেই এলাকায় তত বেশি গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে।

সর্বশেষ খবর