সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নামেই সিটির বাসিন্দা

নেই নাগরিক সুবিধা রংপুর নির্বাচনে ছয় মেয়র প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর থেকে

নামেই সিটির বাসিন্দা

রংপুর পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে রূপান্তর হয়েছে পাঁচ বছর আগে। ৫২ কিলোমিটার আয়তনের রংপুর পৌরসভাকে ২০৩ বর্গকিলোমিটারে উন্নীত করা হয়। আকারে বাড়লেও গত পাঁচ বছরে বাড়েনি নাগরিক সুবিধা। ১৫১ বর্গকিলোমিটার বর্ধিত এলাকার নাগরিকদের ভাগ্যে নগরীর কোনো সুযোগ-সুবিধাই জোটেনি। বর্ধিত অংশে রয়ে গেছে পল্লী বিদ্যুৎ। সিটিতে বসবাস করেও বর্ধিত এলাকার বাসিন্দাদের ৩৪ পয়সা   অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল বেশি দিতে হচ্ছে। মূল নগরীর সড়কের সঙ্গে সংযোগ সড়কগুলো পাকা হলেও অধিকাংশ সড়ক কাঁচা। সড়কে বাতি জ্বলে না। নেই পানি সরবরাহের ব্যবস্থা। ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ছয়টি ওয়ার্ডে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যানজটে জিম্মি নগরবাসী। ফুটপাথ দখলসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত নাগরিকরা। বিরাজমান সমস্যাগুলো আসন্ন নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন। এদিকে আগামী ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের শেষ দিনে গতকাল মেয়র পদে ৭ জন, সংরক্ষিত নারী ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৮১ জনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৩ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৬ জনের মনোনয়ন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ফলে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলেন সাতজন প্রার্থী। তারা হলেন— আওয়ামী লীগের সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু, বিএনপির কাওসার জামান বাবলা, জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, বাসদের আবদুল কুদ্দুস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এ টি এম গোলাম মোস্তফা বাবু ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সেলিম আখতার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। রিটার্নিং ও রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার জানান, ৩০০ ভোটারের সমর্থনের যে তালিকা জমা দেওয়া হয়েছিল, যাচাই-বাছাইকালে সে তালিকায় অনেক ভুয়া ভোটারের নাম থাকায় মেয়র পদে ছয়জনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়। তারা হলেন— এ কে এম আবদুর রউফ মানিক, জেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল আলম নাজু, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ বীরপ্রতীক, ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বনি, শাকিল রায়হান ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী সুইটি আনজুম।   

এ ছাড়া সংরক্ষিত নারী কাউন্সিল পদে ৪ এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৮ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়। এর ফলে এখন ১১টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৬৩ জন এবং ৩৩টি সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২১৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

নগরীর প্রধান সমস্যা যানজট : রংপুর নগরীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে জানতে চাইলে সবাই একবাক্যে বলবেন, যানজটই নগরীর প্রধান সমস্যা। যানজট নিরসনে এক বছর আগে ১২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ১৬ কিলোমিটার প্রধান সড়ক চারলেনে উন্নীত করা হলেও যানজট নিরসন হয়নি, বরং এ সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। সিটি করপোরেশন ৪ হাজার ৮০০ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স প্রধান করলেও চলাচল করছে ৪০ হাজার। পাশাপাশি চলছে ৩০ হাজার প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। নগরীর জাহাজ কোম্পানির মোড় থেকে সিটি বাজার এক কিলোমিটারের পথ হেঁটে যেতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট। সেখানে যানজটের কারণে অটোরিকশায় যেতে সময় লাগে পৌনে এক ঘণ্টা। ফুটপাথ ও সড়ক দখল করে বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসানোয় যানজটকে আরও তীব্রতর করেছে। জানতে চাইলে রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক ওয়াদুদ আলী জানান, যানজটের কাছে নগরবাসী জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ জিম্মিদশা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না।

সুবিধাবঞ্চিত চার লাখ নগরবাসী : রংপুর পৌরসভার আয়তন ছিল ৫২ বর্গকিলোমিটার। এর সঙ্গে ১৫১ বর্গকিলোমিটার যুক্ত করে পাঁচ বছর আগে পৌরসভা সিটি করপোরেশনে রূপ নেয়। পৌরসভার ১৫টি ও বর্ধিত ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সংখ্যা ৩৩টি। মোট জনসংখ্যা ৮ লাখ। এর মধ্যে চার লাখ মানুষের বাস বর্ধিত এলাকায়। গত পাঁচ বছরে এ বর্ধিত এলাকার মানুষ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মূল নগরীর সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত সড়ক নির্মাণ ছাড়া আর কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। অধিকাংশ সড়কই কাঁচা আর খানাখন্দে ভরা। পানি নিষ্কাশনের জন্য নেই কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থাও। সিটি করপোরেশনে নতুন করে যোগ হওয়া এ এলাকায় বলতে গেলে কোনো নাগরিক সুবিধাই নেই। অথচ ঠিকই গুনতে হচ্ছে বাড়তি কর। এখনো নগরীর বর্ধিত অংশে পল্লী বিদ্যুৎ রয়ে গেছে। এতে সিটি করপোরেশনের নাগরিক হয়েও বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ইউনিটপ্রতি বিল ৩ টাকা ৫৩ পয়সা। আর পল্লী বিদ্যুতের ৩ টাকা ৮৭ পয়সা। সিটি করপোরেশনে বসবাস করেও বর্ধিত এলাকার বাসিন্দাদের এখনো ৩৪ পয়সা অতিরিক্ত বিল বেশি দিতে হচ্ছে। নগরীর পুরনো ছয়টি ওয়ার্ডে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও ২৭টি ওয়ার্ডে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। পানি সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়কে বাতিও জ্বলে না। নগরবাসী বলছেন, নাগরিক বৈষম্যের আরেক নাম রংপুর সিটি। মোট ওয়ার্ডের তিন ভাগেই লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। বাড়তি কর দিয়েও কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ বর্ধিত এলাকার বাসিন্দারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আকতার হোসেন আজাদ বলেন, ২০৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিটি করপোরেশনের সব সমস্যা পাঁচ বছরে সমাধান করা সম্ভব নয়। অনেক উন্নয়ন হয়েছে। অনেক কাজ চলমান। বর্ধিত এলাকার মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধানের জন্য প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে।    

নাগরিক ভাবনা : নগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের রঘু বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমরা শুধু নামেই সিটির বাসিন্দা। পাঁচ বছরে নাগরিক কোনো সুযোগ-সুবিধাই পাইনি। এবার ভেবেচিন্তে ভোট দেব। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বড়বাড়ি মাস্টারপাড়া এলাকার কলেজ শিক্ষিকা হাসনা বানু বলেন, ‘পাঁচ বছরে উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার হয়েছি। উন্নয়নের যোগ্য প্রার্থীকে মানুষ বেছে নেবে বলে আশাবাদী’। এদিকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, আগামীতে যিনি নগর পিতা হবেন তাকে কর আদায়ের পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে নাগরিক সেবার প্রতিও। এ প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) রংপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মলয় কিশোর ভট্টাচার্য বলেন, নাগরিক সেবা বঞ্চিত এলাকার ভোটারদের প্রভাব তো আসন্ন নির্বাচনে অবশ্যই পড়বে। যে মেয়র প্রার্থী নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার সামর্থ্য রাখেন ভোটাররা তাকেই বেছে নেবে বলে আমি মনে করি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর