সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্ধুর হাত ধরেই জঙ্গি নেটওয়ার্কে

শাহ্ দিদার আলম নবেল, ছাতক থেকে ফিরে

বাবা-মায়ের ১২ সন্তানের মধ্যে সপ্তম আবদুস সামাদ ছিল দারুণ মেধাবী। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্নকে পূর্ণতা দেবে— এমন লক্ষ্যেই চলছিল সে। কিন্তু বন্ধুর সংস্পর্শে এসে বিপথগামী  হয়ে পড়ে সামাদ; বন্ধুর মতো নিজেও জড়িয়ে পড়ে জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে। বাবা-মায়ের স্বপ্নকে মাটিতে মিশিয়ে সামাদ হয়ে ওঠে দুর্ধর্ষ জঙ্গি। সামাদের গ্রামের বাড়ি ঘুরে মিলেছে এমন তথ্য। প্রায় দুই বছর ধরে নিখোঁজ আবদুস সামাদ গত মঙ্গলবার কলকাতায় আরও দুই জঙ্গির সঙ্গে সেখানকার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। সামাদ সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নের কাটাশলা গ্রামের কলমদর আলীর ছেলে। গ্রেফতার অপর দুই জঙ্গি হচ্ছে বাংলাদেশের রিয়াজুল ও ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনার মনোতোষ দে। আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ তিনজনকে রিমান্ডে রাখার আদেশ দিয়েছে কলকাতার একটি আদালত। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে। কলকাতার পুলিশের সন্দেহ, সামাদসহ গ্রেফতার হওয়া তিনজন আল-কায়েদার সদস্য হতে পারে। আবদুস সামাদের পরিবারের সদস্যরা জানান, ছাতকের মঈনপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে এসএসসি পাস করে আবদুস সামাদ। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, এমন স্বপ্নে পরবর্তীতে সামাদকে সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেন বাবা-মা। সেখান থেকে ২০১৪ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা শেষ করে ডুয়েটে ভর্তি হয় সামাদ। জানা যায়, সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াকালীন ওই প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন শিবির সভাপতি মাহবুব আহমদের সঙ্গে প্রতিভা হলে থাকত সামাদ। প্রায় দেড় বছরের মতো ছিল সেখানে। পরে সিলেট নগরীর মিরাবাজারে মৌসুমী ১২০ নম্বর বাসায় ছোট ভাই সুলেমান আহমদকে নিয়ে ভাড়ায় ওঠে সে। লিডিং ইউনিভার্সিটির সিএসই বিভাগের ছাত্র মামুনও থাকত তাদের সঙ্গে। মামুনের সঙ্গে সখ্য ছিল সামাদের। আবদুস সামাদের ছোট ভাই সুলেমান আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামাদ ও মামুন বাসায় একসঙ্গে বসে টিভি দেখত, দুজনই ছিল মুক্তমনা। হঠাৎ করে পরিবর্তন আসে মামুনের মধ্যে। টিভি দেখা বন্ধ করে সে মনোযোগী হয় ধর্মকর্মে। কিছু দিন পরেই একই পরিবর্তন দেখা যায় সামাদের মধ্যেও।’ সুলেমানের দাবি, প্রথম দিকে এই পরিবর্তন তাদের কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কিন্তু চলতি বছরের শুরুর দিকে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে মামুন আটক হওয়ার পর সামাদের পরিবর্তন নিয়ে তাদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু সে সময় সামাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কোনো সুযোগও ছিল না। এর আগেই পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল সামাদ। সুলেমান আরও দাবি করেন, তার ভাইয়ের পরিবর্তন মামুনের হাত ধরেই হয়েছে। মামুনই সামাদকে বিপথে নিয়েছে। সুলেমান জানান, চলতি বছরের শুরুর দিকে মামুনকে সিলেট শহরতলির মেজরটিলার একটি বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে। কয়েক মাস পর সে জামিনে বেরিয়ে কাতার পালিয়ে যায়। সুলেমান আহমদ জানান, সর্বশেষ ২০১৫ সালে বাড়িতে এসেছিল সামাদ। বাড়ি থেকে যাওয়ার পর তার ফেসবুকের আইডিটিও ডিঅ্যাক্টিভেট করে রাখে সে। এরপর একবারই ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিল সামাদ। আবদুস সামাদের মা আছিয়া বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রায় দুই বছর আগে একদিন ফোন করেছিল সামাদ। উচ্চশিক্ষার্থে সে বিদেশ যাচ্ছে— এ কথা বলেই ফোন রেখে দেয় সে। এরপর ওই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।’ আছিয়া বেগম বলেন, ‘১২ সন্তানের মধ্যে সামাদ ছিল সপ্তম। ছোটবেলা থেকেই সামাদ খুব মেধাবী ছিল। ইঞ্জিনিয়ার বানানো স্বপ্ন নিয়ে তাকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছিল। বিপথগামী হয়ে সে শুধু নিজের নয়, পুরো পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে আছিয়া বেগম বলেন, ‘ছেলে আমার চোখের সামনে ছিল না। আমার কাছে থাকলে হয়তো ওই পথে যেত না।’ সুনামগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘কলকাতায় আটকের খবর পাওয়ার পর সামাদ সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে, সুনামগঞ্জে থাকা অবস্থায় সে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত ছিল না। সিলেটে পড়াশোনা করার সময়ই সে জঙ্গি নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়।’

সর্বশেষ খবর