রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভুয়া ওয়ারেন্টে কারাগারে ৭০ বছরের বৃদ্ধ

তুহিন হাওলাদার

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের অসুস্থ বৃদ্ধ কাঞ্চন মিয়া (৭০)। রাতে নিজ ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। বুটের শব্দে ঘুম ভাঙে তার। ঘরের সামনে কে— জানতে চান কাঞ্চন মিয়া। ‘আমরা পুলিশের লোক। থানা থেকে এসেছি। কাঞ্চন মিয়াকে দরকার।’ ঘরের বাইরে থেকে একজন বলল। এমন কথা শুনে কনকনে শীতের মধ্যরাতে খাট থেকে নেমে সরল বিশ্বাসে দরজা খুলে দেন কাঞ্চন মিয়া। দেখতে পান পুরো বাড়ি ঘিরে আছে পুলিশ। ভয় পান কাঞ্চন মিয়া। জানতে চান, ‘কী ব্যাপার? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? আমার নাম কাঞ্চন মিয়া।’ কাঞ্চন মিয়ার পরিচয় জানতে পেরেই পুলিশ তত্পর হয়ে ওঠে। তার হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে। কাঞ্চন মিয়া অনুনয়-বিনয় করে জানতে চান, তাকে ধরছে কেন? কিন্তু পুলিশ ছিল নির্বিকার। শুধু বলছিল, ‘থানায় চলেন। তারপর বলব। আপনাকেই খুঁজছি আমরা।’ কাঞ্চন মিয়ার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও পুলিশের এমন আচরণে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তারা হতবাক হন। ৭০ বছরের কাঞ্চন মিয়ার ব্যাপারে তারা জানতে চাইলেও পুলিশ কোনো জবাব দেয়নি। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে শুরু হয় তোলপাড়। ৭০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধের বিরুদ্ধে মামলা নেই, অপরাধীও নন। এর পরও তার ঠিকানা এখন কারাগার। স্বজনরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তিনি ভুয়া ওয়ারেন্টের শিকার। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ঢাকার আদালতের এক বিচারকের সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভুয়া ওয়ারেন্ট তৈরি করে পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়টি আদালতে প্রমাণিতও হয়েছে যে, তিনি ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এ কারণে ঢাকা মহানগর হাকিম আহসান হাবীব শাহীন গত ৩ ডিসেম্বর কাঞ্চন মিয়াকে জামিনে মুক্তির আদেশ দেন। কিন্তু অজানা কারণে তিনি এখনো কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারেননি। জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের দক্ষিণপাড়া বালিয়ারদী সরকারবাড়ীর কাঞ্চন মিয়াকে ২৭ নভেম্বর রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে আদালতে হাজির করা হলে কারাগারে পাঠায় কিশোরগঞ্জের দুই নম্বর জি আর আদালত। পরে কাঞ্চন মিয়ার জামিনের জন্য তার স্বজনরা ঢাকায় এসে দালালের হাতে পড়েন। ওই দালাল কাঞ্চন মিয়ার স্বজনদের ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তার (এ ও) কাছে নিয়ে যায়। তখন তাদের এ ও জানান, এটা অনেক কাঠিন কাজ। তবে সব ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু জামিন করাতে ১৫ হাজার টাকা লাগবে। তখন নগদে এ ও সাহেবকে ৪ হাজার টাকা দেওয়া হয়। পরে শুনানির সময় কাঞ্চন মিয়ার স্বজনরা জানতে পারেন এটা ভুয়া ওয়ারেন্ট। সঙ্গে সঙ্গে জামিনও দেন বিচারক। পরে এ ও কাঞ্চন মিয়ার স্বজনদের জানান, বাকি ১১ হাজার টাকা দেওয়ার পর জামিনের কাগজ দেওয়া হবে। টাকা না দিলে কিছুই হবে না। তখন কাঞ্চন মিয়ার স্বজনরা এ বিষয়ে লোকজন ডাকলে এ ও জামিনের কাগজসহ ৪ হাজার টাকা ফেরত দেন। এ বিষয়ে ওই ভুক্তভোগী সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার, আইন সচিব, ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এবং ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোশতাক আহম্মেদ জানান, নিরীহ লোকদের বিনা অপরাধে হয়রানি-মানহানি করতে এ ধরনের কাজ করছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। ফলে ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ভয়ে কেউ কেউ নিজ বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, যদিও তারা জীবনে একটি কলা গাছও কাটেননি। তবুও ভুয়া ওয়ারেন্টে আলোচিত মামলার আসামি হচ্ছেন। জীবন হচ্ছে ওলট-পালট। তাই ভুয়া ওয়ারেন্টের বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধী শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

সর্বশেষ খবর