সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রংপুর মেয়রের সামনে ছয় চ্যালেঞ্জ

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

রংপুর মেয়রের সামনে ছয় চ্যালেঞ্জ

আগের মেয়রের আমলে রংপুর সিটি করপোরেশনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। নগরীর প্রধান সমস্যাগুলো নিরসনে তেমন একটা উদ্যোগ ছিল না। তা ছাড়া মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর আচরণ নিয়েও নানা কথাবার্তা আছে। এমন নানা কারণেই মানুষ মেয়র পদে পরিবর্তন চেয়েছিল। ২১ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার পক্ষে রায়ও এসেছে। বিপর্যয় ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর। ভোটের রেশ কাটতে না কাটতে এখন মানুষের মধ্যে একটাই প্রশ্ন, ক্ষমতাসীন দলের মেয়র হয়েও ঝন্টু যা করতে পারেননি, জাতীয় পার্টির মেয়র মোস্তফা তা করতে পারবেন তো? সরকার ঠিকমতো সহায়তা দেবে কি-না তা নিয়েও আছে সংশয় মানুষের মধ্যে। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন মেয়রকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এর মধ্যে ছয়টি চ্যালেঞ্জ তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে। এগুলো হলো— যানজট নিরসন, পল্লী এলাকার উন্নয়ন, নগরীর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরী খাল দখলমুক্ত ও সংস্কার, নগরীকে মাদকমুক্ত করা এবং নগরবাসীর মন জয় করে চলা।

প্রধান সমস্যা যানজট : রংপুর নগরীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে জানতে চাইলে সবাই এক বাক্যে বলবেন, যানজটই নগরীর প্রধান সমস্যা। এক বছর আগে ১২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ১৬ কিলোমিটার প্রধান সড়ক চার  লেনে উন্নীত করা হলেও যানজট নিরসন হয়নি। বরং এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। সিটি করপোরেশন ৪ হাজার ৮০০ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স দিলেও চলাচল করছে ৪০ হাজার। পাশাপাশি চলছে ৩০ হাজার প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। নগরীর জাহাজ কোম্পানির মোড় থেকে সিটি বাজার এক কিলোমিটারের পথ পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট। সেখানে যানজটের কারণে অটোরিকশায় যেতে সময় লাগে পৌনে এক ঘণ্টা। ফুটপাথ ও সড়ক দখল করে বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসানোয় যানজটকে আরও তীব্রতর করেছে। জানতে চাইলে রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক ওয়াদুদ আলী জানান, নগরীর প্রধান সমস্যার অন্যতম হলো যানজট। যানজটের কাছে নগরবাসী জিম্মি হয়ে পড়েছে। এই জিম্মি দশা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। আশা করছি নতুন মেয়র এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।

পল্লী এলাকার উন্নয়ন : রংপুর পৌরসভার আয়তন ছিল ৫২ বর্গকিলোমিটার। এর সঙ্গে ১৫১ বর্গকিলোমিটার যুক্ত করে পাঁচ বছর আগে পৌরসভা সিটি করপোরেশনে রূপ নেয়। পৌরসভার ১৫টি ও বর্ধিত ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সংখ্যা ৩৩টি। মোট জনসংখ্যা ৮ লাখ। এর মধ্যে চার লাখ মানুষের বাস বর্ধিত এলাকায়। গত পাঁচ বছরে এ বর্ধিত এলাকার মানুষ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মূল নগরীর সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত সড়ক নির্মাণ ছাড়া আর কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। অধিকাংশ সড়কই কাঁচা আর খানাখন্দে ভরা। পানি নিষ্কাশনের জন্য নেই কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা। সড়কে বাতিও জ্বলে না। অথচ ঠিকই গুনতে হচ্ছে বাড়তি কর। এখনো নগরীর বর্ধিত অংশে পল্লীবিদ্যুৎ রয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ইউনিটপ্রতি বিল ৩ টাকা ৫৩ পয়সা। আর পল্লী বিদ্যুতের ৩ টাকা ৮৭ পয়সা। সিটি করপোরেশনে বসবাস করেও বর্ধিত এলাকার বাসিন্দাদের এখনো ৩৪ পয়সা বিল বেশি দিতে হচ্ছে। নগরীর পুরনো ছয়টি ওয়ার্ডে নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও ২৭টি ওয়ার্ডে কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। ক্ষুব্ধ বর্ধিত এলাকার বাসিন্দারা। বাড়তি কর দিয়েও কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা না পাওয়ায় তারা ঝন্টুর ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।

নগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের রঘু বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমরা শুধু নামেই সিটির বাসিন্দা। পাঁচ বছরে নাগরিক কোনো সুযোগ-সুবিধাই পাইনি। মোস্তফা আশার আলো দেখানোয় মানুষ তাকে ভোট দিয়েছেন।

শ্যামাসন্দুরী খাল দখলমুক্ত ও সংস্কার : নগরীর পানি নিষ্কাশনের জন্য শত বছর আগে খনন করা হয়েছিল শ্যামাসুন্দরী খাল। দখল-দূষণে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দীর্ঘদিনে এ খালের দুই ধার দখল করে বাড়ি-দোকান গড়ে তোলায় সেটি শীর্ণ খালে রূপ নিয়েছে। সংস্কারের অভাবে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। খালজুড়ে মশার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ২০১২-১৪ সালে এলজিইডি খাল সংস্কারে ২৫ কোটি টাকা ব্যয় করলেও সৌন্দর্য ফিরে পায়নি শ্যামাসুন্দরী। উচ্ছেদ করা যায়নি দখলদারদের। বিএমএ রংপুর শাখার সভাপতি ডা. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, শ্যামাসুন্দরী খালটি দখলমুক্ত করে                                                                                     সংস্কার করা হলে নগরীর রোগবালাই অনেকাংশে কমে যাবে। দূর হবে জলাবদ্ধতা।

মাদকমুক্ত নগরী গড়া :  রংপুর শহরের সবাই এক বাক্যে বলবেন, মাদকই তাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডের সব খানেই এখন মাদকের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মরণনেশা ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবা ট্যাবলেট। এর ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা এখন বেশি মাদকের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। মাদকে আসক্ত হচ্ছেন এক শ্রেণির পুলিশ সদস্য, মধ্যবয়সী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। তবে ইয়াবার ব্যবহারই সাম্প্রতিক সময়ে চরম আকার ধারণ করায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। জানা গেছে, নগরীর খামারপাড়া, কলেজপাড়া, আলমনগর, বাবুপাড়া, মডার্ন মোড়, পার্ক মোড়, সাতমাথা, আশরতপুর, পুরনো ট্রাকস্ট্যান্ড, চকবাজার, জলকর, খটখটিয়া, হনুমানতলা, রেলস্টেশন, হাজীরহাট, মেডিকেল কলেজ মোড়, দর্শনা মোড়, ভুরারঘাট, বুড়িরহাট, সাহেবগঞ্জ, এলাকাগুলো মাদক কেনাবেচার প্রধান কেন্দ্র। এখান থেকেই খুচরা বিক্রেতার হাত হয়ে মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে পড়ে নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডের গ্রাম থেকে গ্রামে। নগরীর ছিন্নমূল বা দরিদ্র পরিবারের শিশু ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীদের দিয়ে মাদক বহন ও বিক্রি করানো হচ্ছে। নগরীর ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের মীরগঞ্জ এলাকার তামপাট ইউনিয়নভুক্ত ছিল। তখন এ এলাকায় মাদক কেনাবেচা হতো না। এ এলাকার স্কুলশিক্ষক রায়হানুল করিম বলেন, সিটি করপোরেশনের নাগরিক হওয়ার পর গর্ববোধ করেছিলাম। কিন্তু এখন সর্বত্র মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। উঠতি বয়সের ছেলেরা প্রকাশ্যে মাদক সেবন করছে। মাদকের ছড়াছড়ি দেখে এখন মনে হচ্ছে ইউনিয়নের বাসিন্দা থাকাই ভালো ছিল। নতুন মেয়রকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) রংপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মলয় কিশোর ভট্টাচার্য বলেন, যানজট নিরসন, পল্লী এলাকার উন্নয়ন, শ্যামাসুন্দরী খাল দখলমুক্ত ও সংস্কার, নগরীকে মাদকমুক্ত করা এবং নগরবাসীর মন জয় করে চলাটাই নতুন মেয়রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি। নতুন নগরপিতাকে এসব বিষয় অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে মানুষ আগামী নির্বাচনে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নতুন মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরবাসীর প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধানের পদক্ষেপ নেব। এ ছাড়া অবৈধ অটোরিকশা বন্ধ করে দেওয়া হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পল্লী এলাকার উন্নয়ন, শ্যামাসুন্দরী খাল দখলমুক্ত ও সংস্কার করা হবে। মাদকের ব্যাপারে আমার জিরো টলারেন্স। আমি মাটি ও মানুষকে ভালোবাসি। মানুষও আমাকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছে। নগরবাসীর সম্মান রক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করব।

সর্বশেষ খবর