মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১১৫

খুন ঢাকতে আরেক খুন

মির্জা মেহেদী তমাল

খুন ঢাকতে আরেক খুন

ময়মনসিংহের নান্দাইলের ব্যবসায়ী শ্যামল চন্দ্র দাস। ২০০৬ সালের ১৮ আগস্ট তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে আর  ফেরেননি। তাকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি। চার দিন পর বাড়ির কাছের একটি বিলে শ্যামলের লাশ পাওয়া যায়। শ্যামল খুনের ঠিক ১২ দিন পর লাশ মেলে একই মহল্লার আবদুর রাশিদ নামে এক রিকশা  মেকানিকের। আবদুর রাশিদের লাশ পাওয়া যায় একটি গাছে ঝুলন্ত অবস্থায়। থানা পুলিশ তদন্ত করে শ্যামল হত্যার কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি। এরপর তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের পর সিআইডি। কিন্তু খুনে কাউকে পাওয়া যায়নি তাদের তদন্তে। আর মেকানিক আবদুর রাশিদ আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে।

দীর্ঘ ১১ বছর পর এ দুটি ঘটনার তদন্তে নতুন মোড় নেয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে  বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের তদন্তে শ্যামল খুনের খুনিরা শনাক্ত হয়। আর মেকানিক আবদুর রাশিদ আত্মহত্যা করেনি, তাকেও খুন করা হয়েছিল। খুন করেছে শ্যামলের খুনিরাই। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, শ্যামল খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এই আবদুর রাশিদ। যে কারণে তাকেও তারা খুন করে। খুন ঢাকতে খুনিরা আরেক খুনের ঘটনা ঘটায়। পিবিআইয়ের ময়মনসিংহ কার্যালয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, আদালত থেকে ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর নান্দাইলের নাথপাড়া মহল্লার ব্যবসায়ী শ্যামল হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান। মামলার নথিপত্র ঘেঁটে তিনি দেখতে পান, ২০০৬ সালের ১৮ আগস্ট শ্যামল বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন। চার দিন পর বাড়ির কাছের একটি বিলে শ্যামলের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে নান্দাইল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন তাঁর ভাই দিলীপ চন্দ্র দাস। মামলাটি থানা থেকে প্রথমে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পুলিশ এবং পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) আসে। সিআইডি তদন্ত করে আবদুস সালাম ওরফে সম্রাট নামের একজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বাদী এই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দিলে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে আদালত পিবিআইকে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।

এএসপি বলেন, পিবিআই তদন্তে নেমে জানতে পারে যে শ্যামল হত্যার ১২ দিন পর একই এলাকার রিকশা মেকানিক আবদুর রাশিদের লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। থানার পুলিশের তদন্তে আবদুর রাশিদের মৃত্যুর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। অথচ লাশের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। সুরতহাল প্রতিবেদনেও এ কথা উল্লেখ ছিল। এ কারণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্যামল হত্যার ঘটনায় শ্যামলের প্রতিবেশী মৃত অলি নেওয়াজের ছেলে আবদুর রশিদ (৫৫) ও মফিজুল ইসলামের ছেলে আবদুর রশিদ মিয়াকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

এএসপি আরও বলেন, অলি নেওয়াজের ছেলে রশিদ ময়মনসিংহের চতুর্থ আমলী আদালতের বিচারক খালেদা নাসরিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে শ্যামল হত্যায় তিনি নিজেসহ নান্দাইল উপজেলার আচারগাঁও গ্রামের ফয়সল খান, রাজ্জাক, কাজল মিয়া, আশরাফ, লাল মিয়া, হাশেম মিয়া, আবু তাহের, মোফাজ্জল হোসেন, আবদুস সালাম ও রশিদ মিয়া জড়িত বলে উল্লেখ করেন। একই জবানবন্দিতে আসামি রশিদ আরও বলেন, হত্যার উদ্দেশ্যে শ্যামলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে ফেলায় রিকশা মেকানিক আবদুর রাশিদকেও তাঁরা ঘটনার ১২ দিন পর হত্যা করে লাশটি তাঁরই বাড়ির সামনের একটি আমগাছে ঝুলিয়ে রাখেন। জবানবন্দির তথ্যের ভিত্তিতে রিকশা মেকানিকের ছেলে গোলাপ মিয়া বাদী হয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নান্দাইল মডেল থানায় ১১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলাও তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। দুটি মামলা তদন্ত করছেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন।

পিবিআই সূত্রে জানা যায়, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রিকশা মেকানিকের স্ত্রী রাবিয়া আক্তার বলেছেন, ব্যবসায়ী শ্যামল চন্দ্র দাসকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তিনি ও তাঁর স্বামী আবদুর রাশিদ ওই রাতে দেখে ফেলেন। এ কারণে ঘটনার ১২ দিন পর শ্যামলের খুনিরা তাঁর স্বামীকে হত্যা করে লাশ বাড়ির সামনে আমগাছে ঝুলিয়ে রাখে। এ দৃশ্যও তিনি দেখেছেন। এসব ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্য রাশিদের লাশ উদ্ধারের দুই দিন পর গভীর রাতে আশরাফ, লাল মিয়া, রাজ্জাক ও হাশেম (ওরা শ্যামল হত্যা মামলায় জড়িত) তাঁকে (রাবিয়া) ধরে নিয়ে নির্যাতন করেন। পরে তাঁকে মাটিতে ফেলে কিছু তরল জোর করে খাওয়ানো হয়। এতে তিনি অসুস্থ এবং অপ্রকৃতিস্থ হয়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে যান।

সূত্র জানায়, গত ঈদুল ফিতরের আগে রাবিয়াকে অসুস্থ অবস্থায় ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে খুঁজে পান তারা। চিকিত্সকের সহায়তায় রাবিয়াকে কিছুটা সুস্থ করে তাঁর স্বামীর মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ করেন, যা দুটি হত্যা মামলার তদন্তে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর