বুধবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

আন্তরিকতা কৌশলে নারী পুলিশ সেরা

জিন্নাতুন নূর

আন্তরিকতা কৌশলে নারী পুলিশ সেরা

মামলার আসামিদের ধরতে অনেক সময় তাদের অপরাধীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে হয়। পরিচয় গোপন করে মোবাইল ফোনে একজন সাধারণ নারী হিসেবে প্রথমে প্রেমের অভিনয়, অতঃপর কথায় কথায় একসময় ঠিকানা জোগাড় করে বা দেখা করার কথা বলে আসামিদের গ্রেফতার করেন একজন নারী পুলিশ। অপরাধীদের ধরতে নারী পুলিশদের এই কৌশল ও আন্তরিকতা পুলিশ মহলের পাশাপাশি এখন ভুক্তভোগী ও মামলার বাদীদের কাছেও বেশ প্রশংসিত হচ্ছে। আর অপরাধীদের ধরতে নারী পুলিশের এই কৌশলী ভূমিকা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় অতিরিক্ত একটি কর্ম যোগ্যতা হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যরা। সময়ের সঙ্গে আগের চেয়ে বাংলাদেশ নারী পুলিশের উন্নতি হয়েছে। এখন যে নারীরা পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে আসছেন তাদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত। ঢাকাবাসী এরই মধ্যে নারী পুলিশদের আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে নিয়েছেন। নারী পুলিশের দক্ষতা নিয়েও মানুষের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কমেছে। কারণ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারীদের কাছে রাত-দিন বলে কিছু নেই। মধ্যরাতেও নারী পুলিশরা ভয়ঙ্কর সব অভিযানে যাচ্ছেন। বিশেষ করে আত্মহত্যা ও অপমৃত্যুর ঘটনাগুলোতে মধ্যরাতেও ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন একজন নারী পুলিশ। এমনকি ভয়ঙ্কর অপরাধীদের ধরতে এখন পুলিশ দলের নেতৃত্বও দিচ্ছেন নারীরা। আশার কথা এই যে, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে নারী পুলিশ সদস্যরা তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তি মিশনেও। বিভিন্ন নারী নির্যাতন মামলা যেমন—ধর্ষণ মামলায় ভুক্তভোগীরা যতটা সহজে তাদের কথা নারী পুলিশদের কাছে খুলে বলতে পারেন তা একজন নারী ভুক্তভোগী পুরুষদের কাছে তুলে ধরতে সংকোচবোধ করেন। এমনকি নারী উত্ত্যক্তকারীদের গ্রেফতারের জন্যও অনেক সময় নারী পুলিশরা পরিচয় লুকিয়ে, কথার জালে ফেলে অনেক উত্ত্যক্তকারীদের গ্রেফতার করেন। বাংলাদেশ পুলিশের ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের অতিরিক্তি মহাপরিদর্শক (আইজি) ফাতেমা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের এই পেশার প্রতি মানুষের উত্সুক্য বেশি। বিশেষ করে নারীরা যখন পুলিশের পোশাক পরে সড়কে বের হন তখন মানুষ আমাদের দিকে উত্সাহের দৃষ্টিতে তাকান। মেয়েদের জন্য এটি যেমন চ্যালেঞ্জিং পেশা একইভাবে এটি সম্মানজনক একটি পেশা।

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারের উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারী ও পুরুষ পুলিশের সমান যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু মেয়ে হওয়ার জন্য অনেক সময় অযোগ্য হলেও পুরুষ সহকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে নারীরা কষ্ট পান। অথচ সারা দেশের স্পর্শকাতর অনেক নারী নির্যাতনের মামলা তদন্ত থেকে শুরু করে অপরাধীদের গ্রেফতার করছেন নারী পুলিশরা। বড় মামলাগুলোতে পুরুষ সহকর্মীদের তদন্তের কাজেও নারী সহকর্মীরা সহযোগিতা করছেন। নারী বলে পিছিয়ে পড়া চলবে না, এই মানসিকতা ধরে রেখেই নারীদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন পুলিশের এই উপকমিশনার। রূপনগর থানার এসআই হুসনা আফরোজ এই প্রতিবেদককে বলেন, নারী পুলিশ হিসেবে আমি গর্বিত। থানায় ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমি গাড়িতে করে মোবাইল ডিউটিও করি। মোবাইল ডিউটি করার সময় অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। অনেক পুরুষের মধ্য থেকে তাদের তল্লাশি করতে হয়। এর মধ্যে অনেক জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। হুসনা জানান, সম্প্রতি তিনি একজন আসামির সঙ্গে পরিচয় লুকিয়ে ১৫ দিন ধরে মোবাইলে প্রেমের অভিনয় করে একটি মোবাইল উদ্ধার করেন। আর এটি ছিল একটি ধর্ষণ মামলার আসামির মোবাইল। তার মতে এক্ষেত্রে নারী হয়ে মোবাইলটি উদ্ধার করা হুসনার জন্য যতটা সহজ হয়েছিল পুরুষ পুলিশের পক্ষে তা এত সহজ হতো না। কথা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের আরেক নারী উপকমিশনার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছাড়া নারী হিসেবে পুলিশে বাড়তি কোনো সুবিধা তারা ভোগ করেন না। একজন পুরুষ পুলিশ সদস্যের পোস্টিং যত সহজে হয় মেয়েদের ক্ষেত্রে তা হয় না। বরং বিপরীত লিঙ্গের কারণে নারী পুলিশদের নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে তবেই নির্দিষ্ট পদে পোস্টিং দেওয়া হয়। এ কারণে ক্ষেত্র বিশেষে নারী পুলিশ সদস্যদের পুরুষ সদস্যদের চেয়ে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। তবে সামাজিক কারণে নারী পুলিশদের সাধারণ জনগণ অনেক সময় ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে চায় না। মানুষের ধারণা একজন পুরুষ পুলিশের কাছে গেলে সমস্যার সমাধান একজন ভুক্তভোগী যতটা সহজে পাবেন নারীদের কাছ থেকে তা পাবেন না। গত্বাঁধা ধারাণা থেকে অধিকাংশ মানুষ মনে করে যে, নারীরা স্বভাবে পুরুষের তুলনায় কোমল বলে অপরাধীদের সঙ্গে হয়তো ততটা রুঢ় আচরণ করতে পারবে না। অথচ পুলিশ হিসেবে দায়িত্ব পালনের আগে নারী-পুরুষ উভয়কে একই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নারী-পুরুষ পুলিশের ক্ষমতাও সমপর্যায়ের। নারী পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আরও জানা যায়, পুলিশের ইউনিফর্ম পরে একজন নারী যখন রাস্তায় বের হন তখন তিনি যেমন সম্মানিত বোধ করেন তেমনি পুরুষরাও তাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ থেকে বিরত থাকেন। তবে দায়িত্ব পালনে নারীদের তরফ থেকে কোনো আন্তরিকতার ঘাটতি না থাকলেও কাজ করতে গিয়ে এখনো নারী পুলিশদের জন্য নারী বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। কয়েকজন ঊর্ধ্বতন নারী পুলিশ সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, নগরে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা কম থাকায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হয়। এ ছাড়া থানায় অনেক সময় দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে না। এ জন্য তাদের বাইরের খাবার খেতে হয়। সামাজিকভাবে নারী পুলিশদের গ্রহণ করার মানসকিতা আরও বৃদ্ধি করাও প্রয়োজন আছে বলে তারা জানান। কারণ একজন নারী পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে গেলে উত্সুক জনতার চাপে অনেক সময় তাদের দায়িত্ব পালনে সমস্যা হয়। নারী সহকর্মীদের সম্পর্কে জানতে চাইলে রূপনগর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা মো. মিজান জানান, পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী পুলিশরা ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। ব্যবহার তুলনামূলক ভালো হওয়ায় নারী পুলিশরা ক্রমেই মামলার বাদীদের আস্থা অর্জন করছেন।

সর্বশেষ খবর