শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

যুদ্ধাপরাধের আপিল শুনানিতে ২১ মাসের বিরতি

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি দাবি

আরাফাত মুন্না

সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৮ মার্চ আপিল নিষ্পত্তি হয় যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর। মাঝখানে মীর কাসেম ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের রিভিউ (পুনঃবিবেচনার আবেদন) নিষ্পত্তি হলেও যুদ্ধাপরাধের আর কোনো আপিল শুনানি হয়নি। তাই আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় দীর্ঘ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ মামলার তালিকা। দীর্ঘ ২১ মাসের এই বিরতিতে আপিল বিভাগে যুক্ত হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৯টি মামলা। এসব মামলার শুনানিতে আগ্রহ দেখা যায়নি রাষ্ট্রপক্ষেরও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যারা সোচ্চার; তারা বলছেন, দীর্ঘ সময়ে আপিল বিভাগে শুনানি না হওয়ায় পুরো প্রচেষ্টা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি করে দ্রুত এসব আপিল নিষ্পত্তির দাবিও রয়েছে তাদের।

সাধারণত, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে আপিল মামলা দ্রুত শুনানির দিন ধার্য করতে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে আবেদন দাখিল করা হয়। ওই আদালত তারিখ নির্ধারণ করে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়। সে অনুযায়ী শুনানি হয়। তবে এসব আপিলের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে এ ধরনের কোনো আবেদনের কথা শোনা যায়নি। অবশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (সংশোধনী) আইনের ২১(৪) ধারা অনুযায়ী আপিল দাখিল করার ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করার কথা। তবে আইনজ্ঞদের মতে, এই বিধান আপিল বিভাগের জন্য বাধ্যতামূলক নয় বরং নির্দেশনামূলক। আপিল বিভাগ তাদের অন্তর্নিহিত ক্ষমতায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলা শুনানি করবে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং জাতীয় পার্টি (জাপা) নেতা সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলা কার্যতালিকায় আসলেও শুনানি হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যুদ্ধাপরাধের অনেক মামলাই কার্যতালিকায় রয়েছে, তবে এটা ঠিক শুনানি শুরু করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু কার্যতালিকায় আছে, অবশ্যই শুনানি হবে। কবে নাগাদ এসব মামলার শুনানি হতে পারে, এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, আপিল বিভাগের নিয়মানুযায়ীই শুনানি হবে। যুদ্ধাপরাধের এসব আপিল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে কি-না, জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল উত্তর দেন, না।

দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে থাকা এসব আপিল নিষ্পত্তির দাবি জানিয়ে আসছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। প্রথম থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে সংগঠনটি। আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ বিচার থমকে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এই সংগঠনটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যুদ্ধাপরাধ মামলার এসব আপিল দীর্ঘদিন ধরে শুনানি না হওয়াটা খুবই দুঃখ জনক। যখন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি হলেন, তখন থেকেই তিনি এই মামলাগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি দুই ট্রাইব্যুনাল ভেঙে একটি করলেন। এমনকি পুরাতন হাই কোর্ট ভবন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন বিচারপতি সিনহা। তবে আমরা সজাগ থাকায় তিনি সেটা করতে পারেননি। শাহরিয়ার কবির বলেন, আমরা জানি সুপ্রিম কোর্টে অনেক মামলার চাপ রয়েছে। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট ট্রাইব্যুনালের ভিতরেই একটি বিশেষ আপিল বেঞ্চ করে দিতে পারে। এতে সুপ্রিম কোর্টের নিয়মিত মামলা শুনানিতেও বিঘ্ন হবে না, একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের এসব আপিলও দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা সব সময়ই বলে আসছি, এই মামলাগুলো বিশেষ মামলা। একটি দেশের ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সারা জীবন থাকবে না। এই মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই নিষ্পত্তি করতে হয়। বিশ্বের যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, সেসব দেশেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলেও জানান শাহরিয়ার কবির। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার রয়েছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুনও। তিনিও যুদ্ধাপরাধের মামলার যেসব আপিল বিচারাধীন রয়েছে, সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, আমরা সব সময় বলে এসেছি যুদ্ধাপরাধের বিচারটা জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত। আপিল বিভাগ তার নিয়ম অনুসারে বিচার করতে পারে, সেটাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এসব মামলায় অগ্রাধিকার না দিলে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। মুনতাসির মামুন বলেন, পুরো জাতি এই বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে। যে কোনো বিভাগই হোক জাতির আকাঙ্ক্ষার দিকে আগে খেয়াল রাখতে হবে। এই মামলাগুলো কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি বা কোনো ব্যক্তির ক্রিমিনাল অপরাধ না, এটা দেওয়ানি মামলাও নয়। বিশেষ মামলা। আমরা সব সময় বলেছি, কিন্তু আদালত আমাদের কথা বিবেচনায় আনেনি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই এসব আপিল নিষ্পত্তির দাবি জানান তিনি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, যদিও আদালত তার নিজস্ব গতিতে চলে তারপরও বলব, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল স্বল্প সময়ের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে আপিল বিভাগে শুনানি না হওয়ায় পুরো প্রচেষ্টা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের নিষ্পত্তির ক্রম অনুযায়ী মীর কাসেমের পর মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার মোবারক হোসেনের আপিল শুনানি হওয়ার কথা। ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর মোবারকের বিরুদ্ধে রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। ১৮ ডিসেম্বর মামলাটি আপিল বিভাগে আসে। বর্তমানে আপিল বিভাগে চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় থাকা ১৮ যুদ্ধাপরাধীই মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত। নিজেদের খালাস চেয়ে আপিল করেছেন এসব যুদ্ধাপরাধী। অন্য একজন আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

সর্বশেষ খবর