শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাগরপাড়ে শুঁটকি উৎসব

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

সাগরপাড়ে শুঁটকি উৎসব

কক্সবাজার সদরের নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লী। এটি দেশের বৃহত্তম শুঁটকি পল্লী হিসেবে খ্যাত। এ পল্লীতে এখন সারি সারি শুকানো হচ্ছে নানা জাতের মাছ। এ কাজে ব্যস্ত অগণিত নারী-পুরুষ। কেউ মাছ মাচায় রাখছেন, কেউ মাচায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউবা শুকনো মাছ কুড়িয়ে জমা করছেন। এই পল্লী থেকেই খাবার উপযোগী হয়ে শুঁটকি রপ্তানি হচ্ছে দেশ-বিদেশে। 

শুঁটকির কারবার করে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন কক্সবাজারের ব্যবসায়ীরা। শীতের এ মৌসুমে সাগর পাড়ে চলছে শুঁটকি উৎসব। প্রতি মৌসুমে এখানে ব্যবসা হয় হাজার কোটি টাকার। মাছ রপ্তানি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। শুঁটকি নিয়ে হচ্ছে নানা গবেষণাও। নাজিরারটেক মত্স্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার সদরের নাজিরারটেক, সমিতির পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া ও তুরস্কল নামে চারটি শুঁটকি পল্লী আছে। এসব পল্লীতে আছেন ছোট-বড় ৯০৪ জন ব্যবসায়ী। পল্লীগুলোতে কাজ করছেন প্রায় ৬০ হাজার নারী-পুরুষ। প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও সোমবার কক্সবাজার শুঁটকি পল্লী থেকে যানবাহনে করে চট্টগ্রামে আসে প্রক্রিয়াজাত করা শুঁটকি। প্রতি সপ্তাহে ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক শুঁটকি আসে চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জে। প্রতিটি ট্রাক বহন করে ৮ থেকে ১০ টন শুঁটকি। ৯ মাসের মৌসুমে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী মিলে হয় প্রায় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। এসব পল্লীতে প্রক্রিয়াজাত করা উল্লেখযোগ্য মাছের মধ্যে আছে লাক্কা মাছ, ফইল্লা মাছ, সুরমা, পোপা, রূপচাঁদা, কালাচাঁদা, টেকচাঁদা, লইট্টাসহ প্রায় ২০ প্রকারের মাছ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের মাছ হলো রূপচাঁদা। প্রতি কেজি মাছ ৪ হাজার টাকা (ভালোমানের)। এরপর আছে লাক্কা মাছ, প্রতি কেজি ২২০০ টাকা। প্রতি কেজি সুরমা মাছ ১৬০০ টাকা। নাজিরারটেক মত্স্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ সওদাগর বলেন, চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, কর্ণফুলী ঘাটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আমরা সাগরের মাছ সংগ্রহ করি। পরে সেগুলো এখানকার পল্লীতে প্রক্রিয়াজাত করে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০ টন শুঁটকি চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। আমরা এখানে ব্যবসা করলেও নানা সমস্যায় জর্জরিত। দীর্ঘদিনের দাবি বিদ্যুৎ সংযোগ এখনো দেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যুতের অভাবে স্থাপন করা যাচ্ছে না একটি শীতলীকরণ কেন্দ্র (কোল্ড স্টোর) ও বরফ কল। কারণ সড়কপথে আনা মাছগুলো তিন দিন পর নষ্ট হয়ে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। কিন্তু সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে এ সমস্যায় পড়তে হতো না। তা ছাড়া এখানে যাতায়াতের প্রধান সড়কটিও বেহাল। তবে সড়কটির কিছু অংশ ব্যবসায়ীদের নিজস্ব অর্থায়নে সংস্কারও করা হয়েছে। কক্সবাজারে অর্গানিক প্রক্রিয়ায় শুঁটকি প্রক্রিয়াকারক ও শুঁটকি গবেষক মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘২০ থেকে ২৫ জন রপ্তানিকারকের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডে শুঁটকি রপ্তানি করা হচ্ছে। তা ছাড়া কানাডা, লন্ডন, ফ্রান্স ও ইতালিতে শুঁটকি রপ্তানির প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করা হয়েছে। আশা করি খুব শিগগিরই রপ্তানি সম্ভব হবে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও অর্গানিক পদ্ধতিতে শুকানো মাছ সরবরাহ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশের বাইরে ১০ প্রকারের মাছ বেশি সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে আছে লইট্টা, ছুরি, রূপচাঁদা, কালাচান্দা, চিংড়ি, পোয়া, কোরাল, মাইট্টা ও লাক্কা মাছ।’

 ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন ধরনের প্রক্রিয়ায় ভেজা মাছ শুকিয়ে শুকনা মাছে (শুঁটকি) পরিণত করা হয়। এর মধ্যে সাধারণ লবণ, বিষাক্ত লবণ এবং অর্গানিক পদ্ধতিতে বেশি কাজ করা হয়। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণে বিষ ব্যবহার প্রসঙ্গে গবেষক মো. ইসমাইল বলেন, ‘সাধারণত কাঁচা মাছে মাছি বসে। মাছে মাছি বসলে প্রতিটিই ১৭ হাজার ডিম দিতে পারে। ডিমগুলো নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পোকায় পরিণত হয়। এই পোকা থেকে মাছকে রক্ষা করতে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া মাছকে বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াও আক্রান্ত করে। এসব থেকে মুক্ত রাখতে লবণ ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।’ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, বছরের সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত ৯ মাস শুঁটকির মৌসুম। এ সময় দম ফেলার ফুরসত থাকে না। এখানকার শ্রমিকরা দৈনিক, মাসিক ও চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা পায় ১৫০ টাকা মজুরি, ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী শ্রমিকের মজুরি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা এবং বয়স্ক নারী-পুরুষের মজুরি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর