মঙ্গলবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

কিলিং পয়েন্ট টিলাগড়

ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খুনে ধর্মঘট-অবরোধ

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

সিলেট নগরীর টিলাগড় যেন ছাত্রলীগের ‘মার্ডার পয়েন্টে’ পরিণত হয়েছে। প্রায় চার মাসের মধ্যে ব্যস্ততম ওই এলাকায় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণ ঝরেছে দুই ছাত্রলীগ কর্মীর। সর্বশেষ রবিবার রাতে ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খানকে কুপিয়ে খুন করা হয়। অথচ এক সময় এমসি কলেজ ও সিলেট সরকারি কলেজকে কেন্দ্র করে টিলাগড় থেকেই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সিলেটে ছাত্রলীগের রাজনীতি। ঐতিহ্যবাহী এ দুই কলেজে পড়ালেখা করা অনেক ছাত্র নেতা জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে এখন এমসি ও সরকারি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় উত্কণ্ঠার মধ্যে। ছাত্রলীগের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন কলেজ দুটির হাজার হাজার শিক্ষার্থী। মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক রণজিত সরকার টিলাগড়ের রাজনীতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকারী। অতীতে তারা দুজন একসঙ্গে রাজনীতি করলেও এখন তাদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। সেই দূরত্বই টিলাগড়ে তৈরি করেছে বেশ কয়েকটি গ্রুপ ও উপগ্রুপ।

এসব গ্রুপ-উপগ্রুপের নেতাদের সঙ্গে জড়িত কয়েকশ কর্মী। গ্রুপ-উপগ্রুপের নেতারা টিলাগড়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ও কলেজ দুটিতে আধিপত্য বিস্তার করতে তাদের অনুসারী কর্মীদের নিয়ে চালান প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া। সর্বশেষ রবিবার রাত পৌনে ৯টায় প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের হাতে ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খানকে (২২) কুপিয়ে খুন করার মাধ্যমে টিলাগড়ের প্রতি মানুষের আতঙ্কের মাত্রা আরেকদফা বেড়েছে। এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এর আগে ৪ মাসের মধ্যে টিলাগড়ের গ্রুপিং রাজনীতির বলি হতে হয় আরও ২ ছাত্রলীগ কর্মীকে। তারা হচ্ছেন ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম ও ওমর আহমদ মিয়াদ। মাসুমকে নগরীর শিবগঞ্জে ছুরিকাঘাত করা হলেও এ হামলার সঙ্গে জড়িতরা টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তানিম খান হত্যাকাণ্ডে আটক হওয়া সাবেক জেলা ছাত্রলীগ নেতা ডায়মন্ডের অনুসারী তারা। গত ১৬ অক্টোবর প্রকাশ্য দিবালোকে টিলাগড় মসজিদ সংলগ্ন রাস্তার সামনে অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে খুন হয় ছাত্রলীগ কর্মী ওমর আহমদ মিয়াদ। মিয়াদ এমসি কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন। এ খুনের সঙ্গে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মী তোফায়েল আহমদ কারাগারে আছেন। মিয়াদের বাবার করা হত্যা মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরীকে প্রধান আসামি করা হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বাতিল করে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি। টিলাগড় থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে নগরীর শিবগঞ্জে জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুমের ওপর ১৪ সেপ্টেম্বর বিকালে হামলা চালায় ছাত্রলীগ কর্মীরা। আগের দিন রাতে নগরীর সোবহানীঘাটে আলী আহমদ মাহিন নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর করে মাসুমসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী। এর জের ধরেই পরদিন ফোন করে ডেকে নিয়ে মারধর করা হয় মাসুমকে। হামলাকারী মাহিন ও তার সঙ্গীরা টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সেদিন বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে মাসুমের মৃত্যু হয়। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জের মাসুক মিয়ার ছেলে। এই তিন খুনের ঘটনাই শুধু নয়। এর আগে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনেও (৪ জানুয়ারি) উত্তপ্ত ছিল টিলাগড় পয়েন্ট। সেদিন মুখোমুখি ছিল ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ। তাদের মধ্যে দফায় দফায় ঘটেছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। ককটেল বিস্ফোরণ, গুলির ঘটনাও ঘটে। অন্যদিকে, প্রায় ১৭ বছর আগে ২০১০ সালের ১২ জুলাই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন পলাশের বাবা বীরেশ্বর সিংহ। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পলাশের সহপাঠী ও সহকর্মীরা।

ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খুন দুই কলেজে ধর্মঘট : সিলেটে ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খান হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মুরারিচাঁদ (এমসি) ও সরকারি কলেজে অনির্দিষ্টকালের ছাত্রধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ছাত্রলীগ। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে গতকাল এমসি কলেজের সামনে সিলেট-তামাবিল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। পুলিশ গতকাল পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করেছে।

রবিবার রাতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নগরীর টিলাগড়ে নিজ দলের ক্যাডারদের হামলায় খুন হন তানিম খান নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী। তিনি সিলেট সরকারি কলেজের স্নাতকের ছাত্র এবং জেলা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রণজিত সরকার অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য তানিমের সহকর্মীরা মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদের অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ গ্রুপের নেতা-কর্মীদের দায়ী করেছেন। তাদের অভিযোগ রায়হানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের ডায়মন্ড, সাদিকুর রহমান আজলাসহ কয়েকজন ক্যাডার হামলা চালিয়ে ছুরিকাঘাত করে তানিমকে খুন করেছে।

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল থেকে এমসি ও সিলেট সরকারি কলেজে অনির্দিষ্টকালের ছাত্রধর্মঘটের ডাক দেয় ছাত্রলীগ। ধর্মঘটের কারণে গতকাল কলেজ দুটিতে কোনো ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এমসি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের গতকালের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে গতকাল সকাল ১০টা থেকে এমসি কলেজের সামনে সিলেট-তামাবিল সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। অবরোধ শেষে তারা এমসি কলেজ খেলার মাঠে কাউন্সিলর আজাদের নামে চলমান ক্রিকেট টুর্নামেন্টে হামলা চালায়। এ সময় তারা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের জন্য নির্মিত অস্থায়ী মঞ্চ ভেঙে ফেলে। এদিকে, গতকাল বিকালে নিহত তানিম খানের দাফন তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার বুরুঙ্গায় সম্পন্ন হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। তবে নিহতের স্বজনরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন শাহপরান থানার ওসি আখতার হোসেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। এরা হলেন— ছাত্রলীগ নেতা জয়নাল আবেদীন ডায়মন্ড, জাকির হোসেন, আবিদ আহমদ ও রুয়েল আহমদ। তাদের আদালতে হাজির করে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর