শুক্রবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

হাড় কাঁপানো শীতে বিপর্যস্ত ছিন্নমূল মানুষ

সাঈদুর রহমান রিমন

হাড় কাঁপানো তীব্র শীতে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে রাজধানীর জনজীবন। সন্ধ্যার পর বাড়তে থাকা ঠাণ্ডার প্রকোপ অসহনীয় রূপ নিচ্ছে ভোর রাতে। ফলে ছিন্নমূল মানুষ আর রাতের কর্মজীবীরা সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এই শীতেও গৃহহীন মানুষ খোলা আকাশের নিচে রেলস্টেশন অথবা বাস টার্মিনালের যেখানে-সেখানে রাত কাটাচ্ছেন। অসহনীয় শীতে সবচেয়ে নাকাল হচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষরা। তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। এ ছাড়া শিশু ও বৃদ্ধরা শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রচণ্ড শীতেও রেহাই মিলছে না জীবিকার তাগিদে খেটে খাওয়া মানুষদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাঁচা শাকসবজি নিতে আসা এ রকম মানুষের অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা শীতের রাতে অপেক্ষা করেন কারওয়ান বাজারে। এখানে থাকা ছিন্নমূল মানুষদের শীত নিবারণে নেই পর্যাপ্ত পোশাক। ফলে তারা নির্ঘুম রাত কাটাতে         বাধ্য হচ্ছেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কোনো উপায়ান্ত না দেখে তারা বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা কাগজ, ময়লা অথবা শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে শীত থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছেন। সরেজমিন কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা মিলেছে এ রকম অসংখ্য ভাসমান লোকের। গভীর রাতে ছিন্নমূল এসব মানুষ লাইন ধরে শুয়ে থাকেন। কারও গায়ে থাকে একটি পাটের বস্তা, কারও গায়ে ময়লা ছেঁড়া একটি কম্বল, কারও তাও থাকে না। একটি মাত্র পাতলা কাপড় মুড়ি দিয়েই অনেক মহিলাকে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। ফলে তাদের কাছে রাত হয়ে উঠছে চরম যন্ত্রণার। তবে সকালে সূর্যের আলো ফুটলে সে তাপেই জনবহুল রাস্তা বা ফুটপাথের এক কোণে ক্ষণিক ঘুমিয়ে নিচ্ছেন তারা। রীতিমতো মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন রাজধানীর এসব ভাসমান মানুষ। গতকাল খিলগাঁও ফ্লাইওভারের উত্তর প্রান্তের কাছেই ফুটপাথের ওপর পলিথিনে ঘেরা সামান্য একটু জায়গায় শীতে জবুথবু হয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে আমেনা বেওয়া (৬৫), রাজিয়া খাতুন (৪০), সেলিম মিয়া (৭০) সহ কয়েকজনকে। বৃদ্ধ সেলিম মিয়ার গায়ে একটা ছেঁড়া কম্বল জড়ানো থাকলেও আমেনা, রাজিয়াদের তাও জোটেনি। তাই শীতে কাঁপছিলেন তারা। এ সময় রাজিয়ার ছেলে আলিম মিয়া ময়লা-আবর্জনা, ছেঁড়া কাগজ, খড়কুটা জড়ো করায় ব্যস্ত ছিল। এ চেষ্টা ছিল এসবে আগুন ধরিয়ে সেই তাপে শীত নিবারণ করার। আমেনা বেওয়া জানান, এই শীতে ঠাণ্ডা হাওয়ায় কোনো রকমে দিন পার করলেও রাতটা যেন কাটতেই চায় না। শেষ রাতের দিকে যখন শীতের তীব্রতা আরও অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন আগুন জ্বালানোর উপকরণও ফুরিয়ে আসে। এরপরের কয়েক ঘণ্টার কষ্ট অনুমান করাও কঠিন।

খিলগাঁও ছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের চারপাশ, ওসমানী উদ্যান, হাই কোর্ট গেট, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে, কমলাপুর স্টেশন ও স্টেডিয়ামের আশপাশে এমন অসংখ্য ছিন্নমূল পরিবারকে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। তাদের অনেকেই নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে ঢাকায় এসেছেন। কেউ আবার কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন রেল স্টেশন কিংবা কোর্ট-কাচারি সংলগ্ন ফুটপাথে।

বাবা-মা ছাড়া ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের শীত দুর্ভোগের দৃশ্য আরও ভয়াবহ। সারাদিন শহরে ছোটাছুটি করে কাটালেও রাতে কুয়াশামোড়া ফুটপাথই এদের ঠাঁই। এমন কয়েকশ শিশু অবস্থান করে কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায়। কুয়াশা থেকে রক্ষা পেতে ছিন্নভিন্ন পোশাক পরিচ্ছদের এসব শিশু স্টেশন ভবন বা প্লাটফর্মে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলেই পুলিশের ধাওয়া খায়। যাত্রী বিশ্রামাগারে চেয়ারের নিচে, প্লাটফর্মের অন্ধকার কোণে জবুথবু অবস্থায় শিশুরা কেউ ঘুমিয়ে পড়লেও তাদের লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীদের ভাষ্য, এসব টোকাই শিশু ছিঁচকে চুরি চামারি করে। এতে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এসব থেকে রেহাই পেতেই তারা নির্দয় আচরণ করতে বাধ্য হন।

 

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকায় অবস্থান করা মালেক, বাহাজ আলী, মনিরুল, কবীর, সীমা, রুহি, মুন্না, মেরাজ মিয়াসহ ১৫/২০ জন শিশু এই বাস্তবতায় ভিন্ন উপায় বেছে নিয়েছে। তারা আশপাশ থেকে ছিঁড়ে আনা ব্যানার-ফেস্টুনের কাপড় ও প্যানাসাইনের প্লাস্টিক শিটগুলোতে সারাদেহ আবৃত করে রাত কাটায়। বাহাজ আলী (১১) বলে, ‘এগুলোতে শীত মানে না, ঘুমাতেও পারি না। তবুও কুয়াশায় ভেজা থেকে তো বাঁচতে পারি।’ সারারাত নির্ঘুম থেকে কাঁপাকাঁপিতে কাটিয়ে কখন ঘুমাও- এ প্রশ্নের জবাবে আরেক ছিন্নমূল শিশু রুহি বলে, ‘যখন দিনের রোদে তাপ থাকে, তখন মাঠের কোনায় আমরা ক’জন গলাগলি ধরে ঘুমাইয়া লই।’

কয়েক দিনের কনকনে শীতের কারণে একটি কম্বলের আশায় কয়েকজন ভিক্ষুক এসেছিলেন ফার্মগেটের ফুটপাথে। তাদের কয়েকজন একটা করে কম্বল পেয়েছিলেন। খোকন তরফদার, মজু মিয়া ও আলম শেখ জানান, মধ্যরাতে কয়েকজন লোক এসে ক্যামেরার আলো জ্বেলে জ্বেলে একটা করে কম্বল দিয়ে যান। কিন্তু যে কম্বল দেওয়া হয়েছে তা পাটের বস্তার চেয়ে বেশি উপকার দেয় না। কম্বলগুলো এতই পাতলা যে গায়ে দেওয়ার পর এর ভিতর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসা-যাওয়া করে। তাই গায়ে কম্বল জড়িয়ে পাটের বস্তার ভিতরে সারাদেহ ঢুকিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করতে হয়। তেজগাঁও রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে রাত যাপনকারী ময়মনসিংহের সোহরাব হোসেন বলেন, ‘করার কিছুই নেই। কেউ কি আমাদের দিকে ওভাবে দেখে? চাইলে দুই-চার টাকা দেয়। এ দিয়ে পেটের খাবারই হয় না।

শীতের পোশাক কিনব কীভাবে? ’

সাইবেরীয় বাতাস : রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশেই বইছে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘এবার অনেক বিলম্বে শীত এসেছে। পৌষে বলতে গেলে শীত ছিলই না। এর কারণ এ বছর বঙ্গোপসাগরে পৌষ মাসে শক্তিশালী লঘুচাপ ছিল না। লঘুচাপ সৃষ্টি হলে সেখানকার গরম বাতাস উপরে ওঠে যায়। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে সাইবেরিয়া থেকে ঠাণ্ডা বাতাস হিমালয়ের ওপর দিয়ে আরও ঠাণ্ডা হয়ে ছুটে আসে। লঘুচাপ শক্তিশালী না হওয়ায় এ বছর উত্তরের সাইবেরীয় বাতাস আসতে বিলম্ব হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম এলাকা দিয়ে আসা হিমেল বাতাসের দাপটেই এত বেশি শীত।’

ভিড় কাপড়ের দোকানে : তীব্র শীতের কারণে কয়েকদিন ধরে উপচেপড়া ভিড় রয়েছে গরম কাপড়ের দোকানে। রাজধানীর নিউ মার্কেটের দোকানগুলোতে এর দাম বেড়েছে আগের দিনগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। শীত থেকে বাঁচতে রাজধানী ঢাকার ফুটপাথে গরম কাপড়ের দোকান যেমন বেড়েছে, তেমনি বিক্রিও হচ্ছে বেশ। দাম আকাশছোঁয়া। মতিঝিলের ফুটপাথে গতকাল বিকালে গিয়ে দেখা গেছে, মানুষ খুব বেশি দাম করতে পারছেন না। বেশির ভাগ দোকানেই কিছুটা মানসম্পন্ন সুয়েটার হলেই এক দামে বিক্রি হচ্ছে এবং ক্রেতারাও খুব বেশি বাক্য ব্যয় না করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। যে সুয়েটার এই ক’দিন আগেও একশ থেকে দেড়শ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা আড়াইশ থেকে ৩০০ টাকায় এক দামে বিক্রি হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর