শুক্রবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিরল দৃষ্টান্তের এমপি মোহাম্মদ ইউসুফ

নেই এক খণ্ড জমি ও ব্যাংক হিসাব

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

বিরল দৃষ্টান্তের এমপি মোহাম্মদ ইউসুফ

সংসদ সদস্য নাম শুনলেই সাধারণের চোখে ভেসে ওঠে একজন সেবক জনপ্রতিনিধির চেহারা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেকে এ পদটি পুঁজি করে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড় ও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। এমন বিরল সংসদ সদস্যের একজন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মোহাম্মদ ইউসুফ। ব্যতিক্রমী এই সাবেক সংসদ সদস্য উল্টো নির্বাচিত হয়ে নিঃশেষ করেছেন নিজের জমানো টাকা। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ইস্তফা দেন নিজের আয়ের একমাত্র অবলম্বন চাকরিতে। ফলে গত ১৫টি বছর তার কেটেছে বিনা চিকিত্সায় মানবেতরভাবে। যদিও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সাবেক এই সংসদ সদস্যকে উন্নত চিকিত্সার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ সালাম বলেন, ‘মোহাম্মদ ইউসুফের মতো সৎ রাজনীতিবিদ আমাদের দেশে বিরল। তিনি ক্ষমতার শিখরে একসময় অবস্থান করলেও কোনো লোভ তাকে গ্রাস করেনি। আমাদের রাজনীতির জন্য তিনি মডেল।’

ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকা মোহাম্মদ ইউসুফ ছিলেন একসময়ের তুখোড় বামপন্থি নেতা, মুক্তিযোদ্ধা। পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ছাত্রজীবন থেকে বাম রাজনীতি করে আসা এই নেতা জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও রাখেন প্রতিভার স্বাক্ষর। একসময় স্বাধীনতাবিরোধী ফজলুল কাদের চৌধুরীর পরিবারের আধিপত্য ছিল রাঙ্গুনিয়াজুড়ে। তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী পাওয়াই দুষ্কর ছিল। ওই সময় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে নৌকার মাঝি হন ইউসুফ। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার জোয়ারে ধসে যায় যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাম্রাজ্য। তিনি বিপুল ভোটে পরাজিত করেন সাকা চৌধুরীর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। ১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদে রাঙ্গুনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন ইউসুফ। এ সময় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলেও তাকে গ্রাস করেনি লোভ। করেননি সংসারও। দেশের কোথাও তার নামে নেই একখণ্ড জমি। নেই দালান-কোঠা। নেই ব্যাংক হিসাব। যার কারণে সংসদ সদস্য থেকে সরাসরি আপন ভাইয়ের কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিতে হয়েছে তাকে। নিজ গ্রামে ছোট ভাইয়ের চা-দোকান থেকে আসা যত্সামান্য আয়ে ইউসুফের মুখে ভাত জোটে।

মোহাম্মদ ইউসুফের ছোট ভাই মোহাম্মদ সেকান্দার বলেন, ‘আমাদের দেশে এমপি নির্বাচিত হলে অনেকেই কোটি কোটি টাকা আয় করেন। কিন্তু আমার ভাইয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক উল্টো। তিনি এমপি নির্বাচন করতে গিয়ে খোয়ান নিজের জমানো টাকা। নির্বাচিত হওয়ার পর ইস্তফা দেন নিজেরে আয়ের একমাত্র অবলম্বন চাকরিতে। তার মতো সৎ ব্যক্তি এ সমাজে বিরল।’ তিনি বলেন, ‘২০০১ সালে এক কাপড়ে আমার পরিবারে আসেন বড় ভাই (ইউসুফ)। এর পর থেকেই তিনি আমার সঙ্গে রয়েছেন। এরই মধ্যে তার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগ।’ জানা যায়, তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে পরিবারে সবার বড় মোহাম্মদ ইউসুফ। ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন। ’৭৩ সালে রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি পাস করে কর্ণফুলী পাটকলের করণিক পদে চাকরি নেন। সেখানে তিনি শ্রমিক রাজনীতি শুরু করেন। একাধিকবার কর্ণফুলী পাটকল সিবিএর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর ’৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থী হয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। মোহাম্মদ সেকান্দার আরও বলেন, ‘৯১ সালে এমপি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হলেও তিনি আর কখনো দলীয় মনোনয়ন পাননি। ’৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালান। কিন্তু না পেয়ে ঘরমুখী হয়ে যান।’

সর্বশেষ খবর