শিরোনাম
শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইয়াবা ফেনসিডিলের ট্রানজিট এখন জয়পুরহাট

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও মাজেদুর রহমান, জয়পুরহাট থেকে ফিরে

সীমান্ত এলাকা জয়পুরহাট এখন ইয়াবা, ফেনসিডিলের ট্রানজিট। এখান থেকেই বাস, ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকায়। এখন ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নেশাজাতীয় ট্যাবলেট সীমান্তে চোরাকারবারিদের প্রধান পণ্য। প্রশাসনের এক ধরনের প্রচ্ছন্ন ছত্রচ্ছায়ায় মাদক চোরাকারবারিরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এই অবৈধ ব্যবসা। দেখেও না দেখার ভান করায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সামনেই পাচার হচ্ছে এসব মাদক। কখনোবা টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে আটক মাদকদ্রব্য। আবার ট্রেনে পাচারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন জিআরপি পুলিশসহ রেলে কর্মরত কর্মচারীরা। ধামুরহাট, কালুপাড়া, হিলি, চেঁচড়া, ভূঁইডোবা, কড়িয়া, পাগলা দাওয়ানসহ কয়েকটি চিহ্নিত সীমান্ত চোরাচালানের পয়েন্টের সড়কপথ জয়পুরহাটে এসে মিলিত হয়েছে। আর এসব এলাকা থেকে আসা মাদকের বড় বড় চালান সরাসরি চলে আসছে জয়পুরহাটে। এখান থেকেই রুট পাল্টে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

এই জয়পুরহাটকে অঘোষিতভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা ট্রানজিট বানিয়েছে। এ সুযোগে মাদক কারবারিরা জয়পুরহাটেই গড়ে তুলেছে কয়েকটি মিনি গুদাম। এখানে অনেকটা ফ্রি স্টাইলে চলে মাদক বেচাকেনা। এক সময় শুধু ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজার রাজত্ব ছিল জয়পুরহাটে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন ইয়াবার রামরাজত্ব শুরু হয়েছে। জয়পুরহাট জেলার পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন কৌশলে চলছে এই মরণনেশা ইয়াবার ব্যবসা। আর এ ব্যবসা করে রাতারাতি কোটি টাকার মালিক বনেছেন অনেকেই। আর এতে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবাসহ নানা মাদক। একটি সূত্র জানায়, জয়পুরহাট সীমান্ত দিয়েই দিনে অন্তত অর্ধকোটি টাকার মাদক আসছে। জয়পুরহাট সদর উপজেলার ভুটিয়াপাড়া, মঙ্গলবাড়ী এবং পাঁচবিবি উপজেলার বাগজানা, আটাপাড়া, রতনপুর, চেঁচড়া, ভূঁইডোবা, হাটখোলাসহ কয়েকটি গ্রামে এখন মাদক ব্যবসায়ীদের আধিপত্য। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি পুলিশের সূত্রমতে, শুধু বাগজানা এলাকায়ই ৪০০ মাদক কারবারি রয়েছে। এমন অবস্থা সবগুলো সীমান্ত পয়েন্টের। এ এলাকার আপেল, নয়ন, শংকররা গড়ে তুলেছে শতাধিক মাদক কারবারির সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে মাদক মামলায় শংকর কারাগারে রয়েছেন। তবে এসব মাদক ব্যবসায়ী পুলিশ বা বিজিবির হাতে আটক হলেও বেরিয়ে এসে আবার একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার বাগজানা ইউনিয়নের কয়েকটি সীমান্ত স্পটের মধ্যে ভূঁইডোবা ও চেঁচড়া অন্যতম। এ দুটি সীমান্তে যাওয়ার সড়ক এতটাই সরু যে মোটরসাইকেল ছাড়া চার চাকার কোনো যানবাহন যখন-তখন যেতে পারবে না। আর এলাকার বাড়িঘর দেখে মনে হয়, যেন একেকটি দুর্গ। সড়কের দুই পাশের একেকটি বাড়ি মাদকসহ নানা চোরাই মালের অঘোষিত গুদাম। অন্যদিকে চেঁচড়া সীমান্তে গিয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সীমানায় কোনো ধরনের প্রাচীর বা কাঁটাতারের বেড়া নেই। আর এ সুযোগে ওপারের লোকজন এপার এবং এপারের লোকজন ওপার যাচ্ছে কোনো বাধা ছাড়াই। বাংলাদেশের সীমানায় ৫০০ গজ দূরে দূরে একেকজন বিজিবি সদস্যকে পাহারা দিতে দেখা গেছে। এ এলাকায় কোনো অপরিচিত মানুষ এলেই নারী-পুরুষ সবাই জানতে চান, ‘কী লাগবে? ডাইল (ফেনসিডিল), নাকি বাবা (ইয়াবা) কোনটা চাই? বিদেশি সবই আছে আমাদের কাছে।’ জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে সোজা উত্তরে দ্বিতীয় বৃহত্তর স্থলবন্দর হিলির অবস্থান। আর এই সড়ক দিয়ে নানা পণ্যের গাড়ি দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। কিন্তু এই সড়কে পণ্যের গাড়ির চেয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের চলাচল বেশি। বিশেষ করে দুপুরের পর থেকেই মাদকসেবীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। মোটরসাইকেল দিয়ে দুজন বা তিনজন মিলে সীমান্ত পয়েন্টগুলো থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ সব ধরনের মাদক নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ স্পটে গিয়ে মাদক সেবন করে চলে আসছে। এসব মাদকসেবী বা কারবারিরা মোটরসাইকেল এতটা দ্রুতবেগে চালান যে, সড়ক দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচল করতে সাহস পায় না। এদের বেশির ভাগই উঠতি বয়সের যুবক। জয়পুরহাটের সীমান্তবর্তী পাঁচবিবি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফরিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাদক তো একেবারে নির্মূল করা যাবে না। তবে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি এই থানায় আসার পর বিগত দিনের চেয়ে দ্বিগুণ মামলা হচ্ছে। গত দুই মাসে মাদকের ৬৫টি মামলা হয়েছে পাঁচবিবি থানায়।’ এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জয়পুরহাট সদর ও পাঁচবিবি উপজেলার কয়েকটি স্থানে এখন মাদকের মিনি গুদাম গড়ে তোলা হয়েছে। আর এসব মাদকের গুদাম ও কারবারিদের শেলটার দিচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এর মধ্যে সদর উপজেলার কুডিবাড়ী ব্রিজ এলাকায় রয়েছে একটি স্পট। আর এই স্পটের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন জাকারিয়া নামের এক ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা। রাঘবপুর স্পটে জমির উদ্দিন, শিমুলতলী স্পটে সাহেদ আরিফুলসহ আশপাশের ১০টি স্পটের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন এমন কয়েকজন প্রভাবশালী। এসব স্পট থেকে প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকার মাদক জেলার বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে প্রতিনিয়তই অভিযোগ পাওয়া যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে।

জয়পুরহাট জেলার পুলিশ সুপার রশিদুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জয়পুরহাটে ৩০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। আর এসব সীমান্ত দিয়েই মাদকসহ নানা পণ্য আসে। আমরা মাদক নির্মূলে সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মাসে অন্তত ৬০-৬৫টি মাদকের মামলা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন ১০০ জনের বেশি গ্রেফতার হচ্ছে।’ তিনি বলেন, জয়পুরহাট ও হিলি সীমান্ত দিয়ে আসছে ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক। তবে ঢাকা থেকে বগুড়া হয়ে জয়পুরহাটে আসছে ইয়াবা। মাদক ব্যবসায়ীরা খুবই চতুর। তারা সময় সময় স্পট বদলায়। পুলিশ সুপার বলেন, ‘জয়পুরহাট পুলিশ সদস্যদের এক দিনের বেতন দিয়ে এখানকার মাদকসেবীদের সুস্থ করতে একটি কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছি।’ ২০ বিজিবি ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল রাশেদ মোহাম্মদ আনিসুল হক বলেন, ‘সীমান্তে মাদক চোরাচালান প্রতিহত করতে আমরা সর্বক্ষণই প্রস্তুত। গত এক বছরে এই সীমান্ত এলাকা থেকে আমরা সাড়ে ৪ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছি।’

সর্বশেষ খবর