সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

মাদকে ডুবছে পথশিশুরা

৮৫ শতাংশই আসক্ত

জিন্নাতুন নূর

মাদকে ডুবছে পথশিশুরা

রাজধানীতে দিন দুপুরেই দল বেঁধে মাদক নেয় পথশিশুরা। বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে তোলা ছবি —আবু তাহের খোকন

ঢাকার পথশিশুদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। এমনকি ক্ষুধার কষ্ট ভুলে থাকতে এই শিশুরা নিয়মিত মাদক সেবন করে। মাদকাসক্ত পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন ‘বিদ্যানন্দ’-এর কাছ থেকে সম্প্রতি এ তথ্য জানা যায়। সংগঠনটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি জানান, পথশিশুরা ক্ষুধা তাড়াতে ‘ড্যান্ডি’র (জুতায় ব্যবহূত গন্ধযুক্ত আঠা) মতো মাদকদ্রব্য সেবন করছে। অভিভাবকহীন এই শিশুদের অনেকেরই দুই বেলা খাওয়ার সুযোগ হয় না আর এ পরিস্থিতিতে ক্ষুধার জ্বালা যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য তারা মাদক নিচ্ছে। রাজধানীর শাহবাগ, কমলাপুর রেলস্টেশন, মগবাজার, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকার পথশিশুদের দল বেঁধে পলিথিনে ড্যান্ডি নিয়ে রাস্তার ওপর বসেই তা সেবন করতে দেখা যায়। শাহবাগে এই শিশুদের কাছে মাদক গ্রহণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের একজন রুবেল বলে, ‘সারা দিন রাস্তায় কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল কুড়াই। পরে ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি কইরা যে টাকা পাই তা দিয়ে ড্যান্ডি কিইন্না খাই। কোনো দিন খাবার খাইতে পারি আবার কোনো দিন পাই না। যেদিন খাবার পাই না সেদিন ড্যান্ডি খাই। তহন আর ক্ষুদা লাগে না।’

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিশুদের জন্য সেখানে বরাদ্দ আছে মাত্র ১০টি আসন। আর এ ১০টি আসনের সব কটিতেই বর্তমানে মাদকাসক্ত পথশিশুদের চিকিৎসা চলছে। এদের সবাই ড্যান্ডিতে আসক্ত ছিল। এদের চিকিৎসায় কাউন্সেলিং, মেডিটেশন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্যে, ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী পথশিশুরা গাঁজা, সিগারেট, ড্যান্ডির মতো মাদক বেশি গ্রহণ করছে। আর ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা ফেনসিডিল, হেরোইনে আসক্ত। এমনকি মাদক ব্যবসায়ীরা এই পথশিশুদের মাদক বিক্রির কাজেও ব্যবহার করছে।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রধান কনসালট্যান্ট ডা. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই পথশিশু।’ তিনি জানান, ‘প্রয়োজনের তুলনায় শিশুদের জন্য আমাদের নিরাময় কেন্দ্রে আসনসংখ্যাও কম। এজন্য সরকারের পাশাপাশি আমরা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নিরাময় কেন্দ্রের উন্নয়নে সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছি।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদকাসক্ত পথশিশুদের নিরাময় কেন্দ্রে থাকার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ শিশুই সড়কে ঘুরে বেড়ায়। এরা যে পরিবেশে থাকে সেখানে সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আবার এদের অভিভাবকরাও বিভিন্ন মাদক বিক্রেতা চক্রের সঙ্গে জড়িত। বাড়তি আয়ের জন্য তারা সন্তানদেরও মাদক চক্রের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেন। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, নগরীর পথশিশুদের মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন সেবন করে। আর ৮ শতাংশ সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক নিচ্ছে। বিভিন্ন মাদকের মধ্যে পথশিশুরা গাঁজা, হেরোইন, ঘুমের বড়ি ও ড্যান্ডির মতো মাদকে বেশি আসক্ত।

রাজধানীতে পথশিশুদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে বেসরকারিভাবে বিদ্যানন্দ কাজ করছে। এ প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীরা ‘এক টাকার চিকিৎসা’ নামক প্রকল্পের মাধ্যমে বিনোদনমূলক শিক্ষা দিয়ে মাদকাসক্ত পথশিশুদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজ করছেন। প্রকল্পের সমন্বয়কারী ডা. আসমা আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নগরীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় মাদকাসক্ত শিশুদের আমরা শিক্ষা দিচ্ছি। এদের স্বাভাবিক জীবনে আনার জন্য খাবার দেওয়ার পাশাপাশি সপ্তাহে একবার তাদের চুল-নখ কাটা হয়, স্বেচ্ছাসেবীরা যত্ন নিয়ে তাদের গোসল করান এবং পরিষ্কার পোশাক পরিয়ে দেন। তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও নিয়ে যাওয়া হয়। একই সঙ্গে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হয়। মাদকদ্রব্য গ্রহণ না করার জন্য আলাদাভাবে কাউন্সেলিং করানো হয়। এরই মধ্যে কিছু শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর