রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী-উত্তরা রীতিমতো মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মুড়িমুড়কির মতো চলছে মাদক কেনাবেচা। নিরাপদে মাদক সরবরাহের জন্য রয়েছে বিশেষ স্কট সার্ভিস। এসব এলাকার অনেক ক্লাব, হোটেল-রেস্তোরাঁ হয়ে উঠেছে অলিখিত মদের বার। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশ, এমনকি হাই কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা জারির পরও বন্ধ করা যাচ্ছে না মাদকের হাটবাজার। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার ঘুষবাণিজ্য আর মাসহারা পদ্ধতি সচল থাকায় মাদকবিরোধী সব উদ্যোগ-আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে প্রতি মাসে শুধু মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি চক্রই ২০ লক্ষাধিক টাকা পকেটস্থ করছে। একাধিক সূত্র বলছে, এক-দেড় বছর ধরে নাইট পার্টির উদ্যোক্তারা পর্দার আড়ালে থাকলেও কিছু দিন ধরে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। প্রায় প্রতি রাতেই তারা আয়োজন করছেন ড্যান্স ও ড্রিঙ্কস পার্টির। প্রাপ্তবয়সীদের পাশাপাশি অনেক কিশোর-কিশোরীকেও দেখা যায় এসব পার্টিতে। রাতভর উন্মাতাল নাচ-গান শেষে নেশায় বুঁদ হয়ে শেষরাতে ঘরে ফিরে যান তারা। এ ধরনের নাইট পার্টিতে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
রাজধানীতে ২ হাজার ৫০০ অপরাধীর ৮০০ মাদকস্পট : দুর্ধর্ষ আড়াই সহস্রাধিক ফেরারি আসামি রাজধানীর আট শতাধিক মাদকস্পট নিয়ন্ত্রণ করছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরের এক তালিকায় দেখা যায়, ডিএমপির বিভাগ অনুযায়ী রমনায় ৭৪, লালবাগে ৯০, ওয়ারীতে ১১৫, মিরপুরে ১২৫, গুলশানে ১১২, উত্তরায় ৬৮, মতিঝিলে ১২২, তেজগাঁওয়ে শতাধিক চিহ্নিত মাদকস্পট রয়েছে। পুলিশের খাতায় বছরের পর বছর ধরে পলাতক এই আসামিরা ‘ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ও মদের স্পট’ বানিয়ে প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনার আলাদা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। একেকজনের বিরুদ্ধে মাদক বেচাকেনা, চোরাচালান, হত্যাসহ লুটপাট, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসংক্রান্ত ১০-১২টি করে মামলা রয়েছে। এসব মাদকসম্রাট, চিহ্নিত অস্ত্রবাজ ও পেশাদার অপরাধীর নামসহ তাদের মাদকের আখড়াগুলোর তালিকা পুলিশ, ডিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে রয়েছে। প্রতি বছর সে তালিকা পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান চলে প্রশাসনের, আটক হয় খদ্দের ও নিরপরাধ পথচারীরা। সোর্সদের মাধ্যমে পথচলা মানুষের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়েও গ্রেফতার-হয়রানির অসংখ্য নজির রয়েছে।
ঢাকাতেই কারখানা : রাজধানীতে বেশ কয়েকটি কারখানা স্থাপন করে দেদার ইয়াবা তৈরি ও তা বাজারজাত হচ্ছে। তবে এসব কারখানা বার বার স্থান বদল করায় গোয়েন্দা সদস্যরা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ছোট আকারের ইয়াবা কারখানায় প্রতিদিন লক্ষাধিক পিস ইয়াবা উৎপাদন ও বাজারজাত হয় বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। এ ছাড়া চালান আসে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন সীমান্ত ও নৌপথ ব্যবহার করে। অনুসন্ধানে পাওয়া রাজধানীর অভিজাত এলাকায় মাদক বিশেষ করে ইয়াবা নেটওয়ার্কের সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত।নতুন যন্ত্রণা সিসা বার : গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবার রমরমা বাণিজ্যের পাশাপাশি নেশার বাজারে নতুন আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে ‘সিসা’। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডিসহ অভিজাত এলাকাসমূহে রীতিমতো ‘সিসা বার’ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। বিত্তবান ঘরের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে সেসব বারে গিয়ে হাজির হচ্ছে, সিসার ধোঁয়ার নেশায় থাকছে বুঁদ হয়ে। রাজধানীতে গজিয়ে ওঠা শতাধিক সিসা বার নিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও বিপাকে রয়েছেন।
ক্লাবগুলো যখন মদের বার : বৃহত্তর উত্তরার ৪১টি স্পট পরিণত হয়েছে মাদকের খোলাবাজারে। থানা প্রশাসনকে মাসহারা দিয়ে পুলিশি নিরাপত্তা সুবিধায় রাত-দিন চলছে মাদক কেনাবেচা ও সেবনের আসর। গুলশান-বনানী-বারিধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও মাদকের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে। বিশেষ করে অনেক বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে ইয়াবা বিক্রি হয় দীর্ঘদিন থেকে। এ চক্রগুলোকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন বলে অনেক অভিভাবক মত প্রকাশ করেছেন।