সোমবার, ৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ধূলিধূসরিত বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর অপার সম্ভাবনা

বদলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ - ২

মাহমুদ আজহার, তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) থেকে

দেশের সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা। ভারত ছাড়াও নেপাল, ভুটান ও চীনের কাছাকাছি এ স্থলবন্দরটির গুরুত্ব অনেক বেশি। তবে বন্দরটি দেখভালের অভাবে কার্যক্রমে তেমন গতি আসছে না।  ধূলিধূসরিত বন্দরটিতে এখন শুধুই পাথরভাঙা কলের (স্টোন ক্রাশিং মেশিন) বিকট শব্দ আর ধুলোবালিতে আকাশ-বাতাস ভারি। যাত্রীসাধারণ ছাড়াও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে এ এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। শ্বাসকষ্ট ছাড়াও নানা রোগে আক্রান্ত পাথরশ্রমিকরা। এ ছাড়া বাংলাদেশ অংশে সড়কেই দুই পাশে পাথরবাহী ট্রাকের কারণে সাধারণ পর্যটকরা চলাচলও করতে পারছে না জিরো পয়েন্টে। চরম বিঘ্ন ঘটছে ভারতে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষের। বিষয়টি দেখার কেউ নেই। সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র।

শুক্রবার কথা হয় স্থলবন্দরে পাথরশ্রমিক বিনোদ রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দিনভর কাজ করে রাতে বাসায় গেলে শ্বাসকষ্ট হয়। ঘুম থেকে উঠতে পারি না। শরীর দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু জীবন বাঁচানোর তাগিদে কাজ না করেও উপায় নেই।’

তবে স্থানীয় চিকিৎসকরা জানান, পাথরের গুঁড়া ও ধূলিকণা শ্বাসনালিতে ঢুকে ফুসফুসের ক্ষতি করে। এ ছাড়া চোখ জ্বালাপোড়া, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্মা ও ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে। উচ্চ শব্দে শ্রবণশক্তি ও জীবনীশক্তি ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে। পরিবেশ অধিদফতর জানায়, পঞ্চগড়ের জগদল, ভজনপুর ও বুড়াবুড়ি এলাকায় পাথরকোয়ারি হওয়ায় কলগুলোর স্থাপনও ওই এলাকাকেন্দ্রিক। এ ছাড়া ভারত থেকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি হতে বাংলাদেশে পাথর আমদানি শুরু হয়। ফলে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আশপাশে শতাধিক কল স্থাপন করা হয়েছে। এসব কল স্থাপন করেছেন পাথর আমদানিকারকরা। পরিবেশ অধিদফতর জানায়, পাথর ভাঙার অঞ্চল বা জোন নির্ধারণ করা এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত নীতিমালা প্রয়োগকারী সংস্থা হচ্ছে জেলা প্রশাসন। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। এরপর তারা দেখবে কলগুলো নীতিমালার অন্যান্য দিক মেনে যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন জানায়, ধুলোবালি কমাতে পানি ছিটানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য একটি গাড়িও কেনা হচ্ছে। এ ছাড়া যান চলাচলেও নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে ইমিগ্রেশন, উপজেলা পরিষদ ও স্থানীয় প্রশাসন একযোগে কাজ করবে। বন্দর সূত্রে জানা যায়, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ বন্দরে রাজস্ব আয় অনেক বেড়েছে। ২০১৭-১৮ সালের অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২০ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতেই আদায় হয় ১৫ কোটি ৩৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এর আগে ২০১১-১২ সালে ৬ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এক কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২০১২-১৩ অর্থবছর। ওই অর্থবছর ৯ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও আদায় হয়েছিল ১৩ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ২২ কোটি ৩৬ লাখ ৬ হাজার নির্ধারণ হলেও আদায় হয় ২৬ কোটি ৯৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৩৯ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয় ৬০ কোটি টাকা। আদায় করা হয় ৩৫ কোটি ৪০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। আদায় হয় ১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ১৯৯৭ সালে ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীন এই চার দেশের সঙ্গে চতুর্দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে প্রথম শ্রেণির এই স্থলবন্দরটি চালু করা হয়। পরে সরকারিভাবে কয়েকশ কোটি টাকা ব্যয়ে জমি অধিগ্রহণ ও বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বন্দরের ভিতরে এখনো চালু হয়নি স্ক্যান মেশিন। এলসি চালানের টাকা জমাদানের জন্য সরকারি ব্যাংক, পর্যাপ্ত মালামাল লোড-আনলোডের জায়গা, প্রয়োজনীয় জনবল সংকট তো আছেই। ইমিগ্রেশন চালুর পর দেশি-বিদেশি যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য রাজধানী ঢাকা থেকে  কোনো ডে কোচ বা  ট্রেন না থাকায় দিন দিন দুর্ভোগ বাড়ছেই। এমনকি ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দরটি বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে যাতায়াত করাটা সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয়রা জানান, স্থলবন্দরটি এখনো পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। এখনো নানা সমস্যায় জর্জরিত। স্থলবন্দরের ইয়ার্ডে পাথরবাহী ট্রাকের লোড-আনলোডের জায়গার অভাবে রাস্তার উভয় পাশে সারিবদ্ধভাবে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতে পারেন না। দীর্ঘ সময় তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্যদিকে বাংলাবান্ধা বাস টার্মিনাল থেকে বেশ দূরে ইমিগ্রেশন অফিস হওয়ায় সেখানে আসা-যাওয়ায়ও সমস্যা হয়। পর্যাপ্ত রিকশা, অটোরিকশা ও ইজিবাইক না থাকায় যাত্রীসাধারণকে হেঁটে যেতে হয় ইমিগ্রেশন অফিসে। স্থলবন্দরের আশপাশে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় অনেকে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না। এ ছাড়া সরকারিভাবে এলসি ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জার না থাকায় অনেকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে এসে বিপাকে পড়েন। আবার কেউ কেউ দেশি মুদ্রা নিয়ে ভারতের ফুলবাড়িতে মানি একচেঞ্জ করলেও বাংলাদেশ মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাবান্দায় নেই কোনো আবাসিক হোটেল বা খাবারের রেস্তোরাঁ। এ নিয়েও যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমদানি ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী হাসান খান বাবলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বন্দরে নানামুখী সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর পরও বন্দরকে যুগোপযোগী করতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।  যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন আগের চেয়ে উন্নত। তবে  মোবাইল  নেটওয়ার্কসহ অবকাঠামো ও জেলা সদরগুলো থেকে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের দুর্ভোগ রয়েই গেছে।’ তেঁতুলিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শাহিন বলেন, ‘বাংলাবান্দা স্থলবন্দরের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। চারটি দেশ এই স্থলবন্দরের সঙ্গে যুক্ত। আমরা যদি বন্দরকে পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন রাজস্ব আয় বাড়বে, অন্যদিকে পঞ্চগড় হবে দেশের অন্যতম শীর্ষ পর্যটক এলাকা। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। শ্রমিকদের কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে। এতে এ এলাকার সাধারণ মানুষের ভাগ্যেরও পরিবর্তন ঘটবে।’

সর্বশেষ খবর