বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

অলিগলি হাটে-বাজারে হাত বাড়ালেই মাদক

বদলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ - ৪

মাহমুদ আজহার, পঞ্চগড় থেকে ফিরে

অলিগলি হাটে-বাজারে হাত বাড়ালেই মাদক

তেঁতুলিয়া উপজেলা কার্যালয়ের পরিত্যক্ত টয়লেটে ফেনসিডিলের খালি বোতলের স্তূপ

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা চত্বর। পাশেই পুকুরপাড়-সংলগ্ন একটি পরিত্যক্ত টয়লেট। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অর্ধশত নতুন-পুরনো ফেনসিডিলের বোতল। দেখেই বোঝা যায়, সরকারের প্রশাসনিক এ এলাকায় নিয়মিত কেউ কেউ ফেনসিডিল সেবন করে পরিত্যক্ত এ টয়লেটে বোতল ফেলে যান। কেউ কেউ বলছেন, প্রশাসনিক এলাকায় সাধারণ মানুষ ফেনসিডিল নিয়ে আসতে সাহস পাবে না। তবে কি স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের কেউ মাদক সেবন করেন? এমন প্রশ্নেরও জবাব কেউ দিতে পারছেন না। শুধু তেঁতুলিয়া উপজেলা চত্বর নয়, পঞ্চগড়ের হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে, অলিতে-গলিতে হাত বাড়ালেই মাদকের দেখা মেলে। ফেনসিডিল ছাড়াও গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবাসহ নেশাজাতীয় ইনজেকশনও মিলছে হরহামেশা। গ্রামের কিশোররাও এখন মাদক মামলার আসামি হয়ে জেল খাটছেন। কলেজে পড়া ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশও জড়িয়ে পড়ছে মাদকে।

তেঁতুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স অবস্থানে আছি। আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। মামলাও করা হচ্ছে। মাদক বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না সে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন।’ তেঁতুলিয়ার ভজনপুরের ডাঙ্গাপাড়ার ‘র’ আদ্যাক্ষরের এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী অনেকটা প্রকাশ্যেই ফেনসিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা বিক্রি করছেন। কোমলমতি কিশোর, যুবকসহ

বয়স্ক ব্যক্তিদের আনাগোনা তার বাডিতে। ‘র’ আদ্যাক্ষরের ওই ব্যক্তি একাধিকবার মাদক মামলার আসামি হয়ে জেলও খেটেছেন। তবে আইনের ফাঁক গলে তিনি বেরিয়ে এসে একই ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। শুধু তারা দুজনই নন, তেঁতুলিয়ায় তাদের মতো অর্ধশত মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা ঈদ, পূজা ছাড়াও বছরজুড়েই মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছেন। পুলিশের খাতায় তাদের নামও রয়েছে। একাধিক মামলায় আসামি হয়ে জেলও খেটেছেন সবাই। কিন্তু জেল থেকে ফিরে ফের একই পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন তারা।

জানা যায়, তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধার নারায়ণজোত গ্রামের ‘ম’ আদ্যাক্ষর, তিরনই হাটের হাকিমপুর গ্রামের ‘স’, ‘হ’, ‘দ’, ‘শ’ আদ্যাক্ষরের চার ব্যক্তি ফেনসিডিল ও ভারতীয় মদ বিক্রেতা। রণচণ্ডী বাজারের ‘আ’, ‘ত’, ‘ন’, ‘ই’ আদ্যাক্ষরের দুই ব্যক্তি ইয়াবা বিক্রেতা। তেঁতুলিয়া সদরে ‘চ’ আদ্যাক্ষরের এক ব্যক্তি গাঁজা ও ইয়াবা বিক্রেতা। আজিজনগর এলাকার ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি ইয়াবাসহ হাতেনাতে ধরা পড়েন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একই নামে তেঁতুলিয়া ডিগ্রি কলেজের পাশে ডাঙ্গাপাড়ার এক ব্যক্তি ইয়াবা, মদ, ফেনসিডিলসহ নেশাজাতীয় ইনজেকশনও বিক্রি করে থাকেন। কালান্দিগঞ্জ এলাকার ‘আ’ আদ্যাক্ষরের এক ব্যক্তি হেরোইন ও ইয়াবা বিক্রেতা। শালবাহান রোড জামরিগুড়ি এলাকার ‘আ’ আদ্যাক্ষরের এক ব্যক্তি ফেনসিডিল ও গাঁজা বিক্রেতা বলে জানা গেছে। এ ছাড়া উপজেলাজুড়ে বেশ কয়েকজন কিশোর ও যুবক ভ্রাম্যমাণ মাদক বিক্রেতা হিসেবে কাজ করছে। শতাধিক কিশোর মাদকাসক্ত বলেও জানা গেছে। তেঁতুলিয়ার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদকে আসক্ত সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা বেশ শঙ্কিত। ছেলেরা স্কুল-কলেজে যাওয়ার কথা বলে গাঁজার আসরে চলে যায়। তাদের নানাভাবে বোঝানোর পরও কোনো লাভ হচ্ছে না। এ নিয়ে অনেক অভিভাবক নিজ থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হচ্ছেন। কেউ কেউ নিজেই ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন। তবু বাধ মানছে না মাদক। এ ব্যাপারে তেঁতুলিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শাহীন, সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ, ইউপি চেয়ারম্যান কাজী আনিসুর রহমান, রাজনীতিবিদ কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু, শাহাদাত  হোসেন রঞ্জুসহ এলাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা মাদক নিয়ে বেশ উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে তারাও বলছেন, ‘যে  কোনো মূল্যে হোক মাদক থেকে কোমলমতি ছেলেদের সরাতে হবে। এ ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ।’

ড্রাগস ফ্রি বাংলাদেশ (ডিএফবি) মাদকবিরোধী সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক আতিকুজ্জামান শাকিল। মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকিও পেতে হয়েছে। তবু মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সীমান্ত দিয়ে গরুর ব্যবসার আড়ালে মাদক আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরও নিষ্ক্রিয়। তবে পুলিশ মাঝেমধ্যে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে সহজে বেরিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা একই কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।’ জানা গেছে, জেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে এখন প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে মদ-গাঁজা। নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ইয়াবাও। প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে এসব মাদক আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব ব্যবসা চলছে। জেলার আটোয়ারী উপজেলার সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে বেশি গাঁজা প্রবেশ করছে। এ উপজেলায় মাদকের ব্যবসাও জমজমাট। পুরাতন আটোয়ারী, ধামোর, মির্জাপুর, বারোঘাটিসহ আরও কয়েকটি এলাকায় গাঁজার ব্যবসা জমজমাটভাবে চলছে। এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা লক্ষ করা গেলেও মাদক ব্যবসায়ীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীগঞ্জ সদর, কালিগঞ্জ, চেংটিহাজরা, সোনাহার, চিলাহাটিসহ বেশ কিছু এলাকায় প্রকাশ্যে চলছে গাঁজার ব্যবসা। বোদা উপজেলার মাড়য়ো, রানীগঞ্জ, নতুন হাট, ময়দানদীঘি, পঞ্চগড় সদর উপজেলার রত্নিবাড়ী, হাঁড়িভাসা, মডেলহাট, জগদল বাজার, গোয়ালঝার এলাকায় গাঁজার রমরমা ব্যবসা চলছে। ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন সীমান্তপথ দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এসব কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশু-কিশোরদের। এসব সীমান্তপথের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধর্মগড়, জগদল, চেকপোস্ট, হরিপুর,  গোগোর, ফকিরগঞ্জ, স্কুলহাট ও বাদামবাড়ী। এসব সীমান্তপথে আসা মাদক ঠাকুরগাঁও পেরিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের প্রশাসন মাদকের বিরুদ্ধে একরকম জিহাদ ঘোষণা করেছে। আগের চেয়ে মাদক ব্যবসা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। এ কাজে শিশুদের ব্যবহার করার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। অনুসন্ধান করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ১৬ মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছেন। পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবা, নেশাজাতীয় অ্যাম্পোল ইনজেকশন ও গাঁজা জব্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর