শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজপথে ভয়ঙ্কর শিকারি

মির্জা মেহেদী তমাল

রাজপথে ভয়ঙ্কর শিকারি

ঢাকার ধোলাইখালের ব্যবসায়ী পারভেজ হোসেন। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য হেঁটে মূল সড়কের দিকে এগোচ্ছেন। সাদা পোশাকের একদল পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে। টেনেহিঁচড়ে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। খবর যায় পারভেজের পরিবারে। তারা পুলিশ আর র‌্যাবের কাছে ছোটাছুটি করেন। কিন্তু কোনো খবর পান না। পরদিন ফোন আসে পরিবারের কাছে। পারভেজের মুক্তির বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। মুক্তিপণ দাবি করার পরই পরিবার নিশ্চিত হয়, পারভেজকে আটক নয়, দুর্বৃত্তরা অপহরণ করেছে। কিন্তু ঠিক সময়ে টাকা জোগাড় হয়নি। তিন দিন পর পারভেজের লাশ পাওয়া যায় পানগাঁও এলাকায় বুড়িগঙ্গায়। পল্লবীর ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। বাসা থেকে বেরিয়েই হাওয়া। খোঁজ নিতে গিয়ে পরিবারের সদস্যরা হয়রান। লোকজনের মুখে তারা জানতে পারেন, খলিলকে সাদা পোশাকের পুলিশ মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো পুলিশের কাছেই খলিলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাত দিন পর ড্রেন থেকে খলিলের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়।

খলিল আর পারভেজের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। তবে তারা খুশি যে, হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটির লাশ অন্তত মিলেছে। অনেকের তাও মেলেনি। কেউ ফিরেছেন মুক্তিপণের টাকা দিয়ে। মৃত ভেবে ফেলে রেখে যাওয়া যুবক রিয়াদ জীবন পেয়েছেন অলৌকিকভাবে। রিয়াদকে মৃত ভেবে দুর্বৃত্তরা গাজীপুরের ঘন জঙ্গলে ফেলে দেয়। রাজধানীর মগবাজার মোড়ের কাছাকাছি জনাকীর্ণ সড়কের একটি ঘটনা। এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন একটি ব্যাংক থেকে। তার হাতে একটা ব্যাগ, ব্যাগে ৭ লাখ টাকা। হঠাৎ চারজন লোক তাকে ঘিরে ধরেন, তাদের কারও হাতে ওয়াকিটকি, কারও হাতে হ্যান্ডকাফ। তারা নিজেদের পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্য বলে পরিচয় দেন এবং লোকটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাশে দাঁড়ানো একটি মাইক্রোবাসে জোর করে ওঠান। সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোবাস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করে। রাস্তার লোকজন ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ আর্তচিৎকার শুনতে পায়। তারা দেখতে পায়, ছুটন্ত মাইক্রোবাসটির কাচের জানালায় জোরে জোরে ধাক্কা পড়ছে, সেই সঙ্গে মাইক্রোবাসের ভিতর থেকে ভেসে আসছে মরিয়া চিৎকার : ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ রাস্তার জনতার পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকায় নির্বিকার থাকা সম্ভব হয় না; তারা চিৎকার করতে করতে ছুটন্ত মাইক্রোবাসটির পিছু নেয়। মাইক্রোবাস কিছু দূর যাওয়ার পরই যানজটে আটকে যায়; উত্তেজিত জনতা সেটির কাচের জানালা ভেঙে ফেলে। কোন ফাঁকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ধারী লোকগুলো তাদের ওয়াকিটকি-হ্যান্ডকাফ ফেলে লাপাত্তা! জনতা শুধু অপহৃত হতে যাওয়া লোকটিকে দেখতে পায়। তারপর পুলিশ আসে। জনতা জানতে পারে, যারা লোকটাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তারা ভুয়া ডিবি। পুলিশও জানতে পারে, এরা পুলিশবেশী ভয়ঙ্কর চক্র। যারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিকার খুঁজতে রাজপথে মাইক্রোবাসের ভিতরে বসে থাকা এই চক্রের হাতে থাকে অস্ত্র, ওয়াকিটকি ও মোটা লাঠি। তাদের ভাবভঙ্গিও অনেকটা পুলিশ-র‌্যাবের মতো। ব্যস্ততম সড়কে গাড়ির গতিরোধ করে তারা তল্লাশির নামে শিকার ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ছুটে চলে অজানার উদ্দেশে। পুলিশের কাছে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের পর চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও কার্যত তাদের শিকড়ের সন্ধান তারা এখনো পায়নি। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক জানান, ইতিমধ্যে এ ধরনের প্রতারক চক্রের বেশকিছু সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মৃত ভেবে ফেলে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসা সেই রিয়াদ জানান, ‘অফিসের কাজ শেষে অটোরিকশায় গুলশান থেকে যাত্রাবাড়ী মীরহাজিরবাগের বাসায় ফিরছিলাম। লিঙ্ক রোডের কাছাকাছি পৌঁছলে পেছন থেকে দ্রুতগতির একটি মাইক্রোবাস আমার অটোর সামনে এসে থামে। মাইক্রোবাসে বসে থাকা ব্যক্তিরা তাদের থামার সংকেত দেন। চালক রাস্তায় সাইড করে অটো থামান। মাইক্রোবাস থেকে চার ব্যক্তি নেমে এসে অটোটি ঘিরে ফেলে। তাদের হাতে ছিল ওয়াকিটকি, মোটা লাঠি। এরা প্রত্যেকেই ছিল সাদা পোশাকে। তারা প্রথমে সিএনজির কাগজপত্র দেখতে চায় চালকের কাছে। চালক কাগজপত্র দেখালে তারা সন্তষ্ট হয়। এরপর তারা আমাকে সিএনজি থেকে নামিয়ে শরীর তল্লাশি করে। আমার পকেটে থাকা ব্যবসার ৩ লাখ টাকা সম্পর্কে জানতে চায়। আমি বলি এটি ব্যবসার। আর কিছু না বলেই আমাকে ঠেলে মাইক্রোবাসের ভিতর নিয়ে যায়। আমার কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়।’ রিয়াদ বলেন, ‘মাইক্রোবাসে উঠেই চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় আরও এক ব্যক্তিকে দেখতে পাই। চোখ বাঁধা লোকটি সিটের নিচে বসে ছিলেন। এরপর আমার চোখ বেঁধে ফেলে ওরা। আমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। চোখ ও হাত বেঁধে আমাকেও সিটের নিচে বসিয়ে রাখে। মাইক্রোবাসও চলতে থাকে। একপর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে আমাকে মাথার পেছনে আঘাত করে। এরপর বুঝতে পারি আমার শরীরে ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে। এরপর আমি অস্বস্তিবোধ করি। সম্ভবত আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ রিয়াদ বলেন, ‘একসময় চোখ মেলে অস্পষ্ট কিছু দেখছিলাম। ওই সময়টা সন্ধ্যা বা রাত হবে। আবারও দুটি ইনজেকশন দেয়। এরপর আমি কিছু মনে করতে পারছিলাম না। আমি যখন চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করি, বুঝতে পারি আমি কোনো গাড়িতে রয়েছি। হঠাৎ আমাকে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বুঝতে পারি, আমি কোনো ঝোপঝাড়ের মধ্যে আটকে আছি, চারদিক শুধু অন্ধকার। পুরো শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। ক্ষতবিক্ষত অবস্থা। চোখ খুলতে পারছিলাম না। হামাগুড়ি দিই। সামনের দিকে এগোতে থাকি। বুঝতে পারি কোনো একটা সড়কের ওপর আমি। দূরে একটি দোকানের মতো দেখা যাচ্ছিল। টিম টিম করে আলো জ্বলছে। সেখানটায় যেতে থাকি হামাগুড়ি দিয়ে। দোকানের কাছাকাছি যেতে পারিনি। রাস্তাতেই শুয়ে পড়ি। চোখ খুলে দেখি আমার মাথায় কেউ পানি ঢালছেন। যে দোকান দেখে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই দোকানের লোকজনই আমার মাথায় পানি ঢালছিলেন। তারাই আমার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দেন আমাকে।’ র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এ ধরনের চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। পুলিশ ও র‌্যাবের নাম-পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের অভিযান চালায়। গাজীপুরের চৌরাস্তা এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ধারী সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের পাঁচ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ভুয়া পুলিশ সম্পর্কে মানুষকে অ্যালার্ট থাকতে হবে। যারা চক্রের সদস্য, তাদের ওয়াকিটকি সচল থাকবে না। পিস্তলও থাকে খেলনার। পুলিশের জ্যাকেট পরা থাকে না। এসব বিষয় খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর