মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

তালপাখার গ্রাম হাঁপানিয়া

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর

তালপাখার গ্রাম হাঁপানিয়া

তালপাতার পাখার বাতাস খুব শীতল। তাই এ পাখাকে বলা হয় গরমের দিনের প্রাণের সখা। গ্রীষ্মের খরতাপে কাহিল প্রকৃতির বুকে তৃষাতপ্ত শরীর একরাশ শান্তির পরশে জুড়িয়ে দিতে অনবদ্য তালপাখা। শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি আর মমতার বুননে হাতে তৈরি তালপাখাই জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের হাঁপানিয়া ফকিরপাড়া গ্রামের মানুষের। বছরের ছয় মাস হাতপাখা তৈরি তাদের দিয়েছে বাড়তি উপার্জনের সুযোগ। মহিলাদের করেছে স্বাবলম্বী। তবে প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণসুবিধা না থাকায় সম্ভাবনাময় এ শিল্প বিকশিত হচ্ছে না। নাটোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাঁপানিয়া গ্রামটিতে তালগাছ না থাকলেও এখন তালপাতার গ্রাম নামেই এর পরিচয়। সরেজমিন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার পাখা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পরিবারের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ছোট-বড় সবাই তালপাখা তৈরির সঙ্গে জড়িত। ফাল্গুনের শুরুতে তালপাখার চাহিদা বেশি থাকে বলেই সবাই মিলে তা তৈরি করেন। তালপাখা তৈরির কারিগররা জানান, এর প্রধান কাঁচামাল ডাগুরসহ তালপাতা। উত্তরের জেলা নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তালপাতা কিনে আনতে হয় পৌষ মাসের শুরুতে। প্রতিটি পাতা ডাগুরসহ কিনতে খরচ পড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা। এই ডাগুরগুলোকে পাখার আকারে গোল করে কাটা হয় সতর্কতার সঙ্গে। কাটার পর রোদে শুকানো হয় কয়েক দিন। শুকানো শেষে গুচ্ছ হয়ে থাকা ডাগুরের সংকুচিত পাতা প্রসারিত করা হয় বাঁশের তৈরি কাঠির মাধ্যমে। পাতার এক একটি শিরা প্রসারিত করে কয়েক শিরা মিলে দুই প্রান্তে আটকানো থাকে কাঠি। এভাবে রাখার পর তালপাতা স্বাভাবিক প্রসারিত আকার ধারণ করলে গোলাকার পাখাটি রং করা বাঁশের খিল দিয়ে দুই পাশ আটকে সেলাই করে দেওয়া হয়। একটি তালপাখা কাঁচামাল থেকে তৈরি করতে খরচ হয় আরও ২ থেকে ৩ টাকা। গড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা দামের তালপাখার কারিগররা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ১২ থেকে ১৫ টাকায়। প্রধানত রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, খুলনা, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে তালপাখার চাহিদা মেটায় হাঁপানিয়ার পাখা। তালপাখা তৈরিতে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করেন নারীরাও। সংসারের দৈনন্দিন কাজকর্মের পাশাপাশি পৌষের শুরু থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন নারীরা। তবে এর মজুরি একেবারেই কম। ১০০ পিস পাখা তৈরি করলে মজুরি পাওয়া যায় মাত্র ৩৫ টাকা। ৩ থেকে ৫ জন নারী একসঙ্গে বসলে ঘণ্টায় ৩০০টি পাখা অনায়াসে তৈরি করতে পারেন। হাঁপানিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা সাবেজান বেগম জানান, তিনি এ গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকে অদ্যাবধি তালপাখা তৈরি করছেন। তালপাখা তৈরি করেই তিনি তার সন্তানদের মানুষ করেছেন ও বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার পুত্রবধূও সংসারে বাড়তি উপার্জনের জন্য পাখা তৈরি করেন। সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আলাউদ্দীন বলেন, গত ৪ দশক ধরে তালপাখাই আমার জীবিকার উৎস। দীর্ঘ সময় পাখা তৈরি করলেও সরকারি কোনো সহায়তা বা ঋণ পাইনি। পাখার চাহিদা বরাবরই বেশি আর ঋণ পেলে আরও বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব। মুনসুর আলী নামের অপর এক পাখা প্রস্তুতকারী বলেন, গ্রীষ্মের শুরুতে যে পরিমাণ পাখা এ গ্রাম থেকে সরবরাহ করা হয়, তাতে সরকারের উচিত পাখা পল্লী হিসেবে গ্রামটিকে ঘোষণা করা। তিনি বলেন, নিজস্ব পুঁজি কম থাকায় কোনো কারিগরের পক্ষে বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব হয় না। জেলা প্রশাসক মাহিনা খাতুন জানান, আত্মনির্ভর এ ধরনের উদ্যোগকে প্রসারিত করার জন্য সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

সর্বশেষ খবর