বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

লক্কড়-ঝক্কড় যশোর বেনাপোল মহাসড়ক

৪৫ মিনিটের রাস্তা যেতে সাড়ে তিন ঘণ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর ও বেনাপোল প্রতিনিধি

লক্কড়-ঝক্কড় যশোর বেনাপোল মহাসড়ক

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৩৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটারই চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পুরো সড়কে কার্পেটিং উঠে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় গর্তের। শুষ্ক মৌসুমে সড়কটি ধুলাবালিতে একাকার হয়ে থাকে। বর্ষায় কাদাপানিতে টইটম্বুর সড়কটি মরণফাঁদে পরিণত হয়। সড়কটির এ বেহাল দশায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। নষ্ট হচ্ছে যানবাহন। দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে পড়ছে এর প্রভাব। ৪৫ মিনিটের রাস্তাটি অতিক্রম করতে এখন সময় লাগছে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। শার্শার কাগজপুকুর গ্রামের আক্তার আলী বলেন, কয়েক দিন আগে আমার এক আত্মীয় হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে যশোর নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সড়কের বেহাল দশার কারণে গাড়ি রিকশাভ্যানের চেয়েও আস্তে চলছিল। পথেই আমার সে আত্মীয় মারা যান। সোহাগ পরিবহনের বেনাপোল কাউন্টারের ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, সড়কের যে অবস্থা প্রতি ট্রিপ শেষে গাড়ি আবার মেরামত না করে রাস্তায় ওঠানো যাচ্ছে না। গাড়ির ডেমারেজ দুই গুণ, তিন গুণ বেড়ে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে চালকরা গাড়ি চালাতে চাচ্ছেন না। আনোয়ার হোসেন নামে এক ট্রাকচালক বলেন, রাস্তার অবস্থা এতটাই খারাপ যে, গাড়ির স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। ট্রাকের যন্ত্রাংশ প্রায়ই নষ্ট হচ্ছে। দুর্ঘটনাও ঘটছে। যশোর-বেনাপোল সড়কের বেহাল দশার কারণে আমদানিকারকরা বেনাপোল বন্দর থেকে সরে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেহাল রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রাক চালকদের রাজি করানো যাচ্ছে না। যদিও ট্রাক পাওয়া যায়, স্বাভাবিকের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এ অবস্থা চলার পর সম্প্রতি সড়কটি প্রশস্তকরণ ও সংস্কার করার জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে সড়কটির দুই পাশে শতবর্ষী কয়েকশ রেইনট্রি গাছসহ প্রায় আড়াই হাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। হাই কোর্টের নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায় গাছ কাটা। বন্ধ হয়ে যায় রাস্তা প্রশস্তকরণ ও সংস্কারের কাজও। পরে সরকার যশোর-বেনাপোল সড়কের বেশি খারাপ অংশটুকু মেরামতের জন্য ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, গাছ কাটার ওপর হাই কোর্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় যশোর-বেনাপোল সড়ক রিকনস্ট্রাকশনের পরিবর্তে এখন শুধু মেরামত করা হবে। বেনাপোলের কাছাকাছি ৮-১০ কিলোমিটার অংশ কিছুটা ভালো আছে। সেটুকু বাদ দিয়ে ২০ কিলোমিটার অংশ মেরামতের জন্য সরকার ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এই টাকায় ২০ কিলোমিটার রাস্তার ওপর ৫০ মিলিমিটার পুরুত্বের ওভারলে হবে। গত ২৭ জানুয়ারি এ কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। আর দরপত্র খোলা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। রাস্তা সম্প্রসারণের বিষয়ে কী করা হবে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, শতবর্ষী গাছগুলো রেখে রাস্তা সম্প্রসারণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এসব গাছের মোটা মোটা শেকড় রাস্তার ওপর চলে এসেছে। বেশির ভাগ গাছের আয়ুষ্কালও শেষ। ডালপালা ভেঙে পড়ছে। এরকম গাছ রাস্তার ওপর রাখলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরও বেড়ে যাবে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ খুলনার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন জানান, মেরামত প্রকল্পের আওতায় যশোর-বেনাপোল ৩৮ কিলোমিটার সড়কের সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মোট ২৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে এই কাজের দরপত্র ও ঠিকাদার নিয়োগের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চলতি মাসের শেষের দিকে সড়কে সংস্কার কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, এই কাজের আওতায় সড়কের যেসব স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে তা ইট-পাথর দিয়ে ভরাট করে পুরো সড়কে বিটুমিনের স্তর দেওয়া হবে। এতে এই সড়কে যাতায়াতের ভোগান্তি কমবে। আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ হবে। উল্লেখ্য, বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী সড়কটির দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতের পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে দমদম পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার সড়কটি সেদেশে যশোর রোড নামে পরিচিত। আর বাংলাদেশ অংশে যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার সড়কটি যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক নামে পরিচিত। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে বেনাপোল স্থলবন্দরের গুরুত্ব দিন দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে ভবিষ্যতে এ সড়কটি চার বা ছয় লেনে উন্নীত করতেই হবে। তখন শতবর্ষী এ গাছগুলোসহ সব গাছই কেটে ফেলতে হবে। তা ছাড়া গাছগুলোর বেশির ভাগেরই আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার কারণও হচ্ছে গাছগুলো। এসব কারণে এবার রাস্তা সম্প্রসারণের সময়ই গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন গাছগুলো রেখেই সড়কটির উন্নয়নে বিকল্প চিন্তার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল। তারা বলছেন, এতগুলো গাছ একবারে কেটে ফেললে তা যশোর অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।

সর্বশেষ খবর