সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেশের অগ্রগতি যেন না থামে

স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের অগ্রগতি যেন না থামে

স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত গুণীজনদের সঙ্গে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —বাসস

জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির হাতে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পদক-২০১৮ বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

অনুষ্ঠানে জীবিত পদকপ্রাপ্তদের অভিনন্দন এবং যারা মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই বাংলাদেশকে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। জাতির পিতার লক্ষ্য ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলা। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের চলমান অগ্রগতি যেন থেমে না যায় এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি হিসেবে বাংলাদেশ কারও কাছে হাত পেতে নয় বরং বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে এবং নিজস্ব সম্পদ দিয়েই আত্মনির্ভরশীল হবে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব এবং এ দেশকে আমরা আরও সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাব। মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, উন্নয়নসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য এই পদক প্রদান করা হয়। এ বছর যারা স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন তারা হচ্ছেন— কাজী জাকির হাসান (মরণোত্তর), শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসান (মরণোত্তর), শংকর গোবিন্দ চৌধুরী (মরণোত্তর), এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ (অব.) বীর উত্তম-এসিএসসি, এম আবদুর রহিম (মরণোত্তর), ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী (মরণোত্তর), শহীদ লে. মো. আনোয়ারুল আজিম (মরণোত্তর), সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী (মরণোত্তর), শহীদ আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (মরণোত্তর), শহীদ মতিউর রহমান মল্লিক (মরণোত্তর), শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক (মরণোত্তর), আমজাদুল হক, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, কৃষি সাংবাদিকতায় চ্যানেল আইয়ের পরিচালক (বার্তা) শাইখ সিরাজ, চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যাপক ডা. এ কে এম ডি আহসান আলী, সমাজসেবায় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান, সাহিত্যে সেলিনা হোসেন ও খাদ্য নিরাপত্তায় ড. মো. আবদুল মজিদ। পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা নিজে এবং মরণোত্তর পদক বিজয়ীদের পক্ষে তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন। অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মজিদ পুরস্কার বিজয়ীদের পক্ষে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন এবং স্বাধীনতা পদক বিজয়ীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন। এ পর্যন্ত ২৪৭ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে ৩ লাখ টাকার চেক, ১৮ ক্যারেট সোনার একটি পদক ও সনদ দেওয়া হয়।

তাদের বিচার হওয়া উচিত— প্রধানমন্ত্রী : একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের যারা মন্ত্রী-এমপি বানিয়ে মদদ দিয়েছেন, পুরস্কৃত করেছেন তাদেরও বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বিকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, যারা যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের মদদ দিয়েছেন, মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছেন তারাও তো সমান অপরাধী। অপরাধীদের যারা পুরস্কৃত করেছেন, তাদেরও সমানভাবে বিচার হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।

এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন চাননি। তিনি বলেন, প্রত্যেক জায়গায় যারা গণহত্যায় শামিল ছিল তাদের মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টাসহ বড় বড় পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ওই গণহত্যাকারীরাই ছিল তাদের পেয়ারের লোক।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণহত্যাকারী ও সহায়তাকারী উভয়ই সমান অপরাধী। এটা যেন আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভুলে না যায়। গণহত্যাকারীদের বিচার চলছে। পাকি প্রেমীদের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে, তাদের পাকি প্রেম ভুলিয়ে দিতে হবে। তা না করতে পারলে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’। আমরা তা প্রমাণ করেছি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় আসীন হয়েছি। আগামী ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী ও ২০২১ সালে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। তিনি বলেন, কি পেলাম কি পেলাম না, তার জন্য রাজনীতি করি না। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই আমার রাজনীতি। দেশবাসীকে বলব, যারা পাকি প্রেম এখনো ভুলতে পারেনি, যাদের অন্তরে এখনো পাকিস্তান তাদের পাকি প্রেম ভুলিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, ’৭৫-এর পর যারাই ক্ষমতায় এসেছিলেন, তারা দেশের উন্নয়ন করেননি। কারণ দেশের উন্নয়ন করলে পাকিস্তান অখুশি হবে। তাদের অন্তরে পাকিস্তান। সে কারণে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া দেশের উন্নয়ন করেননি। কারণ তাদের একই এজেন্ডা ছিল পাকিস্তানকে খুশি করা।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। পাকিস্তানের পাসপোর্টসহ বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিলেন গোলাম আযম। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সেই গোলাম আযমকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন। পাকিস্তানি পাসপোর্ট হাতেই কিন্তু গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে ওই যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারীদের রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেন জিয়াউর রহমান।

পিলখানার ওয়ারলেসের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণা সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যায় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ দেশের মানুষ কিন্তু প্রতিরোধ শুরু করে। ২৫ মার্চের গণহত্যার আগে থেকেই কিন্তু তারা গণহত্যা করেছেন। আন্দোলনের সময়ও তারা হত্যা করেছেন।

২৫ মার্চের নির্মম চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বাড়ির আশপাশে সব বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান। জাকির খান সাহেব এসে আমাকে, রেহানাকে নিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যখন বের হই তখন রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে আমি নিজে দেখেছি। ধানমন্ডি, মিরপুর রোড থেকে শুরু করে ঢাকা শহরে শুধু লাশ আর লাশ। বস্তিতে আগুন দিয়েছিলেন, মানুষের চিৎকার আর দাউ দাউ করা আগুন। সব জায়গায় বাড়িতে বাড়িতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা, যে বাড়িতে পতাকা দেখেছেন সে বাড়িতেই হামলা করেছেন। তিনি বলেন, ২৬ মার্চ আমাদের একটি বাড়িতে আটক রাখা হয়। বাড়ির উপরে কামান ফিট করে রাখা হয়। বাড়ির পাশ দিয়ে যারাই যান তাদের ওপর চালানো হয় গুলি। ওইদিন হায়দার আকবর খান রনোর মা, বোনকে গুলি করা হয়। গাড়ির ড্রাইভার ঘটনাস্থলে নিহত হন। শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা তৎকালীন বিশ্বের সব মিডিয়াতে এসেছে। অল্প সময়ে এত মানুষ হত্যা এ রকম গণহত্যা কিন্তু আর কোনো দেশে ঘটেনি। সেই গণহত্যা গিনিজ বুক অব রেকর্ডেও উঠে এসেছে। এটা ছিল সব থেকে ভয়াবহ, মারাত্মক এবং অধিক সংখ্যার গণহত্যা। ইউটিউবে গিয়ে যদি সার্চ করা যায় অনেক তথ্য এখন পাওয়া যায়। পৃথিবীর এমন কোনো পত্রিকা নেই যেখানে এই গণহত্যার কথা ওঠেনি।

২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ২৫ মার্চ রাতে আমাদের দেশে গণহত্যা শুরু হয়। গত বছর জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব এসেছিল। আমরা ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ২৫ মার্চকেই আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে ’৭৫-এর পর যারাই ক্ষমতায় এসেছেন, তারা কোনো কাজ করেননি। সে কারণেই আমরা এই দিনকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভার সূচনা বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দলের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন, দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ জহির বীর প্রতীক, দলের কেন্দ্রীয় সদস্য নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান।

সর্বশেষ খবর