সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
স্বাধীনতা জাদুঘর

মুগ্ধতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানছে তারুণ্য

জিন্নাতুন নূর

মুগ্ধতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানছে তারুণ্য

দৃষ্টিনন্দন স্বাধীনতা জাদুঘর। গতকাল তোলা ছবি —জয়ীতা রায়

স্বাধীনতা জাদুঘর-বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস যেখানে নান্দনিকরূপে তুলে ধরা হয়েছে। দেশের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে স্থানটিতে সংগঠিত হয়েছিল সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র এই ভূগর্ভস্থ জাদুঘর। উদ্বোধনের পরপরই জাদুঘরটির অনন্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা শৈলী সব বয়সী দর্শকদের দৃষ্টি কেড়েছে। গতকাল আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছিল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণী। জাদুঘরে প্রদর্শিত দেশ স্বাধীনের আগের ও বাংলাদেশের জন্মলগ্নের বিভিন্ন ঘটনার ছবি, পোস্টার ও পত্র-পত্রিকায় স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে ইতিহাস তার প্রদর্শনী মুগ্ধ হয়ে দেখছে তরুণ প্রজন্ম। দর্শক এই জাদুঘরে মুঘল শাসনামল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের বিজয় দিবস পর্যন্ত দেশের দীর্ঘ সংগ্রাম ইতিহাসের সচিত্র বর্ণনা দেখতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের বিশাল ছবিগুলোও এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। মাটির নিচে জাদুঘরের অবস্থান হলেও জাদুঘর প্রকল্পের অন্যতম একটি অংশ হচ্ছে মাটির ওপরের ৫০ মিটার বিশিষ্ট একটি আলোক স্তম্ভ। যা কাচের প্যানেল দ্বারা নির্মিত। এটি ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নামে পরিচিত। নন-বিল্ডিং অ্যাপ্রোচে তৈরি এই প্লাজার ওপরের টাওয়ারটি হচ্ছে আনন্দ উল্লাসের প্রতীক। আর স্তম্ভের সামনে জাদুঘরে প্রবেশের মুখে লম্বা দেয়ালজুড়ে টেরাকোটার ম্যুরালে দেশ স্বাধীনের পুরো ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্বাধীনতা স্তম্ভের ম্যুরালের অংশ পার হয়ে এর প্রবেশমুখটি সোজা জাদুঘরের প্রদর্শনস্থলের দিকে চলে গিয়েছে। দর্শকদের এ জন্য ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যেতে হবে। স্বাধীনতা টাওয়ারের ঠিক মাটির নিচে যে এত সুন্দর একটি জাদুঘর আছে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা জাদুঘরের তিনটি অংশ। প্রথম অংশে আছে বাংলা ভাষা ও বাংলার উৎপত্তিসহ স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন সময়কার আন্দোলনের ছবি। যা শেষ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ছবি দিয়ে। ২য় অংশে আছে একটি অন্ধকার কুঠরি। সেখানে একাত্তরের ভয়াবহ দিনের ছবি, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। সেখানে কালো রঙের দেয়ালে প্রদর্শিত ছবিগুলোতে ভয়াল সেই দিনগুলোর নির্মমতা ফুটে উঠেছে। এই অংশের নাম ‘কালো অধ্যায়’। আর ৭ মার্চের স্মৃতিফলক পেরিয়ে যাওয়ার পর যে গোলাকার ফোয়ারা তার তলদেশে আছে একটি গর্ত। যা দিয়ে পানি যাচ্ছে অন্ধকার গর্তে। ৭১’র নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ দিনের স্মৃতির প্রতীক এই স্থাপনা। আর ৩য় অংশে লড়াই, সংগ্রাম ও বিজয়ের। এটি শেষ হয়েছে বাঙালির বিজয় অর্জনের ছবি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। জাদুঘরে আরও আছে ১৫৫ আসনবিশিষ্ট আধুনিক মিলনায়তন। এতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয়। এতে বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আলোকচিত্রের মাধ্যমে ১৪৪টি প্যানেলে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাতে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রায় তিনশর মতো আলোকচিত্র। স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখে স্বাধীনতা জাদুঘরে ঘুরতে এসেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের একদল শিক্ষার্থী। স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে তারা এই জাদুঘরের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্দেশেই এখানে আসেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তাদেরই একজন মাহমুদ রনি বলেন, ‘আমরা এতদিন বড়দের কাছ থেকে কিংবা পাঠ্যবই পড়ে স্বাধীনতার ইতিহাস জেনেছিলাম। কিন্তু এই জাদুঘরে পুরো মুত্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেভাবে প্রদর্শিত হয়েছে তা দেখে মনে হলো দেশের তরুণ প্রজন্মের একবারের জন্য হলেও এখানে আসা উচিত। এ ছাড়া এই জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি দুটি বিশাল আঙ্গিকে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে আত্মসমর্পণের ছবিটির ঠিক পাশে আত্মসমর্পণের দলিলটিও বড় করে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে। এর সামনেই কাঠ ও কাচের বাক্সে লাল-সবুজের গালিচার ওপর ঐতিহাসিক সেই টেবিল। ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার কাছে এই টেবিলে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। তবে এই টেবিলটি একটি রেপ্লিকা (অনুকৃতি স্থাপনা)। জাদুঘরের দায়িত্বরতরা জানান, মূল টেবিলটি বর্তমানে আছে জাতীয় জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট গ্যালারিতে। সাধারণের জন্য ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই জাদুঘরটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের এখতিয়ারে একটি শাখা জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত। ৬৭ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত জাদুঘরটির নকশা করেন বাংলাদেশের স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম। সপ্তাহের বৃহস্পতিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা। শিশুদের ১০ টাকা। বিদেশিদের ১০০ টাকা। আর প্রতিবন্ধীদের কোনো প্রবেশমূল্য নেই।

সর্বশেষ খবর