রূপকথা-উপকথায় আছে ঘোড়ার গাড়ির কথা। এতে আছে রাজকীয় ঐতিহ্যের অংশ। তার চেয়ে বেশি আছে রাজপুত্রের টগবগিয়ে চলা তেজি ঘোড়ার গল্প। ঘোড়ার গাড়ি অনেক জায়গায় ‘টমটম’ নামেও পরিচিত। পুরান ঢাকায় ঐতিহ্য বেয়ে পৌনে দুইশ বছরেরও বেশি সময় পার করেছে রাজকীয় বাহন এই ঘোড়ার গাড়ি। বর্তমানে এটি বিলুপ্তির পথে। যানজটের নগরী এই ঢাকার রাস্তাজুড়ে শুধু চোখে পড়বে রিকশা, গাড়ি, বাস-মিনিবাস। বিভিন্ন উৎসবের দিনেও নেই এ থেকে মুক্তি। যানজটের জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথাও ঘুরতে বের হওয়ারও থাকে না কোনো আগ্রহ। কেউ রিকশা, কেউ বা গাড়ি, কেউ পার্কে বসে, আবার কেউ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ঘুরতে পছন্দ করেন। জানা গেছে, অতীতে রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ, জমিদাররা ঘোড়ার গাড়িকেই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতেন। ঘোড়ার গাড়ি ছিল রণাঙ্গনের রসদ সরবরাহের প্রধান বাহন। ১৮৩০ সালে ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। তখন এ দেশে ছিল ইংরেজ শাসন। এ সময় পুরান ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোড়ার গাড়ি চলত। সদরঘাট-গুলিস্তান যাত্রী পরিবহনের জন্য ঘোড়ার গাড়িকে অন্যতম বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে এখনো নিয়মিত ৪৮টি ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করছে। জনপ্রতি ভাড়া নেওয়া হয় ২০ টাকা। যাত্রী পরিবহন ছাড়াও এ ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয় বিয়ে, পূজা, বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রা এবং সিনেমার শুটিংয়ে। তবে এসব কাজে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য এক রূপে। কোচোয়ান ও হেলপারের জন্যও ওইসব অনুষ্ঠানের সময় রয়েছে বিশেষ পোশাক। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিয়েতে ঘোড়ার গাড়িকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিয়ে উপলক্ষে ঘোড়ার গাড়িগুলো রঙিন করে সাজানো হয়। ফুলের মালা দিয়ে, আর রঙিন কাগজ কেটে নকশা বানিয়ে সাজানো হয় ঘোড়া আর গাড়ি দুটোকেই। অনেকেই পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই গাড়ি থেকে দৈনিক দুই-আড়াই হাজার টাকা আয় হয় বলে জানা গেছে। বিপ্লব নামে ঘোড়ার গাড়ির এক মালিক এ প্রতিবেদককে জানান, বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ৬-৮ হাজার টাকা হিসেবে চুক্তি করা হয়। গুলিস্তান-সদরঘাটে চলাচলের জন্য প্রতিদিন গুলিস্তান লাইনম্যানকে ৬০ টাকা, সদরঘাট লাইনম্যানকে ৭০ টাকা দিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন খাতে মাসিক ১ হাজার ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। যাত্রীদের আজও রাজা-বাদশাহদের ভ্রমণের আবহ উপভোগ করার সুযোগ করে দেয় পুরান ঢাকার এ ঘোড়ার গাড়ি।
মানুষ আজও নতুন প্রজন্মকে ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ছুটে আসেন ঘোড়ার গাড়ির কাছে। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঘোড়ার গাড়িকে দেখা হয় আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। আর্মেনীয়রা আঠারো ও উনিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় বসবাসকারী প্রভাবশালী সম্প্র্রদায় ছিল। ব্যবসার উদ্দেশ্যে তারা সে সময় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দোকান খুলেছিল। তার মধ্যে শাঁখারীবাজারের ‘সিরকো অ্যান্ড সন্স’ অন্যতম। ওই দোকানে বিভিন্ন ইউরোপীয় জিনিসপত্র বিক্রি হতো। সিরকোই প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু করে। তখন এটি ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। পরে তা অন্যতম প্রধান যানবাহনে পরিণত হয়। বর্তমানে বঙ্গবাজার, ফায়ার সার্ভিস, পশু হাসপাতাল, বকশীবাজার, নারিন্দা, সিদ্দিকবাজার ও সায়েদাবাদ এলাকায় রয়েছে ঘোড়ার আস্তাবল। কামাল নামে ঘোড়ার গাড়ির এক কোচোয়ান জানান, পুরান ঢাকার রাস্তায় চলাচলের পাশাপাশি তারা ঈদ, পহেলা বৈশাখ, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, বিয়েসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে ভাড়া যান। আর এ কারণেই বেঁচে আছে তাদের কয়েক পুরুষ ধরে চালিয়ে যাওয়া টমটমের ব্যবসা। ঘোড়ার গাড়ির মালিকরা জানান, লোহার ও স্টিলের তৈরি দুই ধরনের ঘোড়ার টমটম রয়েছে পুরান ঢাকায়। এক জোড়া ঘোড়াসহ একটি গাড়ির দাম এখন প্রায় ৫ লাখ টাকা। ঘোড়ার পেছনেও খরচ হয় কয়েক গুণ। বিশেষ করে ছোলা, গম, ভূসি ও বুট খাওয়াতে হয়। ভূসি আর ঘাস দিয়ে এক জোড়া ঘোড়ার পেছনে তাদের খরচ হয় ৬০০-৮০০ টাকা। দুই চাকাবিশিষ্ট একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ানো হয় আটজন যাত্রীকে। ২০ বছর আগে সদরঘাটে ৮০-১০০-এর মতো ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করত। তখন যাত্রীসংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। বিক্রমপুর, দোহার, মানিকগঞ্জ হাট থেকে তারা ঘোড়া কিনে আনতেন।