সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

পঞ্চগড়ের অধিকাংশ নদী এখন মরা খাল

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

পঞ্চগড়ের অধিকাংশ নদী এখন মরা খাল

করতোয়ার বুকে চলছে ধান চাষ

দেশের সর্ব উত্তরের জেলাকে নদীর জেলা বললে ভুল হবে না। কারণ এই জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট-বড় ৪৪টি নদী। অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে নদীর সংখ্যা ৩৩। নদীর জেলা হলেও এই জেলার অধিকাংশ নদীই এখন মরা খাল। অর্ধমৃত এসব নদীর বিস্তীর্ণ বালিয়ারিতে দুলছে সবুজ ধানখেত।

অনেক নদীর নাম আছে কিন্তু অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। কোনো কোনোটি বিলীন হওয়ার পথে। এই নদীগুলোতে একসময় বিপুল জলরাশি প্রবহমান ছিল। স্রোতের সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসত পলিমাটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও জেলার কৃষি অর্থনীতিকে সচল রাখত।

বাংলাদেশ নদী ও পরিবেশ বাঁচাও সংগঠনের উপদেষ্টা ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, পঞ্চগড়ে ৪৪টি নদীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তবে পঞ্চগড়ের নদীগুলোতে সারা বছর পানি প্রবাহিত হলেও অধিকাংশ নদীই এখন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার এবং স্থানীয়দের নির্বিচারে নদীর গতিপথ বন্ধ করে পাথর উত্তোলনের কারণে এসব নদী হারিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পঞ্চগড়ের পরিবেশে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

জানা গেছে, পঞ্চগড়ের ভূমিকে প্লাবিত করে ৮টি অভিন্ন (আন্ত সীমান্ত) নদী প্রবহমান। মহানন্দা, করতোয়া, ডাহুক, তালমা, ঘোড়ামারা, বুড়ি তিষ্ণা, টাঙ্গন ও নাগর। এই নদীগুলোর উৎপত্তি ভারতীয় ভূখণ্ডে। ভারত এই নদীগুলোর মধ্যে ৬টি নদীর বুকে ব্যারাজ নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে ছয়টি নদীই এখন পানিশূন্য। এই নদীগুলোর ধু-ধু বালুচরে এখন নদীপাড়ের কৃষকেরা ধান চাষ করছে। এদিকে পঞ্চগড়ের স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীরা ও গ্যাটকো লিমিটেড নামের একটি চা কোম্পানি ডাহুক নদীতে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে এই নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে। অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে মানচিত্র থেকে এমনটাই আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। এ প্রসঙ্গে গ্যাটকোর ম্যানেজার জুয়েল জানান, স্থানীয় নেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে পাথর তোলার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছি। পঞ্চগড়ে তালিকাবহির্ভূত অভিন্ন নদী রয়েছে ১১টি। বেরং, কুড়ুম, চাওয়াই, ভেরসা, গোবরা, রনচণ্ডি, যমুনা, পাঙ্গা, আলাইকুমারী, ভাতা ও শাঁও। এসব নদীও পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। এর মধ্যে ভেরসা, চাওয়াই, গোবরা নদীর গতিপথ বন্ধ করে পাথর উত্তোলন চলছে। ফলে এসব নদীরও অচিরেই বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই জেলায় ২৩টি উপনদী নানাভাবে কৃষি ও পরিবেশকে সমৃদ্ধ করেছে। এই নদীগুলো জেলার মধ্যে বিভিন্ন কান্দর (স্থানীয় ভাষায় জলাশয়কে কান্দর বলা হয়) উৎপত্তি। কোনো কোনোটি  বড় নদীগুলোর শাখা নদী। এগুলো হলো খরখরিয়া, বোরকা, পাম, সুই, ছাতনাই, কুরুন, কালিদহ, রাঙ্গাপানি, দারা, পাথরাজ, হাতুড়ি, ভুল্লি, পেটকি, রসেয়া, পাইকানি, তিস্তাভাঙ্গা, বহিতা, শালমারা, চিলকা, জারী, বাঘমারা, কাটগিরি, হুয়ারী ও  ঝিনাইকুড়ি। এই নদীগুলো সারা বছর প্রবহমান থাকলেও কোনো কোনো নদী একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। নদী ভরাট করে কৃষিজমি ও ভিটেবাড়ি সৃষ্টি এবং পাথর উত্তোলনের ফলে চিলকা, ছাতনাই, বাঘমারা, দারা, ঝিনাইকুড়িসহ আরও কয়েকটি নদী শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ইতিমধ্যে করতোয়া নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বোদা উপজেলার বারুনি ঘাট থেকে জুড়ান ঘাট পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার খনন করা হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী উসমান গনি জানান, ২০১৬ সালে করতোয়া নদী খননের প্রস্তাব পাঠানো হয়। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। পাঁচ উপজেলার আরও পাঁচটি নদী খননের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, ডাহুক নদীর গতিপথ বন্ধ করে পাথর উত্তোলন চলছিল। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে পুনরায় ডাহুক নদী খনন করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। নদী দখল একটি অপরাধ। এ বিষয়ে আমরা কাউকেই ছাড় দেব না।

সর্বশেষ খবর