সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

সেই ভয়াল ভৈরবের মরণদশা

সাইফুল ইসলাম, যশোর

সেই ভয়াল ভৈরবের মরণদশা

ভৈরবের দুই তীর দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে ভবন

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দীর্ঘতম নদ ভৈরব। যার অর্থ ভয়াবহ। পদ্মা থেকে পাওয়া পানিতে একসময় ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় নদটির নাম ভৈরব হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় আড়াই শ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদের তীরেই গড়ে ওঠে যশোর-খুলনাসহ অসংখ্য শহর, নগর। ভারতের মালদহের  ভিতর দিয়ে প্রবাহিত শ্রুতকীর্তি মহানদী যেখানে পদ্মায় মিলিত হয়ে, বিপরীত দিক দিয়ে ভৈরব নামে বের হয়ে অনেক দূর অতিক্রম করে পদ্মার দক্ষিণমুখী আরেক শাখা মাথাভাঙ্গার সঙ্গে মিলে যায়। পরে মাথাভাঙ্গা থেকে ভৈরব পৃথক হয়ে যশোরে প্রবেশ করে বসুন্দিয়া, নওয়াপাড়া, ফুলতলা, দৌলতপুর, সেনহাটি, সেনেরবাজার, আলীপুর, চাঁদপুর, ফকিরহাট, পানিঘাটা, বাগেরহাট, খলিফাবাদ ও কচুয়া অতিক্রম করে বালেশ্বর নদীতে মিশেছে। ওদিকে চৌগাছার তাহেরপুরে ভৈরব থেকে দক্ষিণ দিকে কপোতাক্ষ নামে বের হয়েছে যশোর অঞ্চলের আরেকটি প্রধান নদ। এ দুই নদের তীরেই বিকশিত হয়েছিল আর্য সভ্যতা। এ দুই নদ থেকে বের হয়েছিল অসংখ্য শাখা নদী। যশোর অঞ্চলের প্রধান দুটি নদ ভৈরব-কপোতাক্ষের আজ মরণদশা। ফলে এ দুটি নদের অসংখ্য শাখা নদীর অবস্থাও করুণ। ভরা বর্ষায় এসব নদ-নদীতে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। আর শুষ্ক মৌসুমে এসব নদ-নদীর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তবে আশার কথা, বর্তমান সরকার ভৈরব নদ খনন করতে ‘জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থা উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পে ইতিমধ্যে ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় খননকাজ শুরুও হয়েছে। তবে ভৈরবের যশোর অংশে শতাধিক দখলদার থাকায় খননকাজ কিছুটা থমকে গেছে। প্রশাসন বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোকে মানুষ কখনো কখনো নিজের ইচ্ছামতো প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে। বেশি ফসল উৎপাদনের জন্য নদীর স্বাভাবিক গতি নিয়ন্ত্রণও করেছে। এসব প্রচেষ্টা সাময়িক সুফল দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল দেয়নি। বরং নদী শাসনের ভয়াবহ রূপ দেখা গেছে যশোর-খুলনা এলাকার দুঃখ হিসেবে পরিচিত ভবদহ এলাকায়। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৭৯৪ সালে কপোতাক্ষে বাঁধ দিয়ে ভৈরবে স্রোত প্রবাহিত করে যশোর শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন যশোরের ওই সময়ের কালেক্টর। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর নদীয়ার কালেক্টর শেক্সপিয়র দর্শনার কাছে মাথাভাঙ্গার বাঁক সোজা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ১৮৬২ সালে আসাম বেঙ্গল রেললাইন নির্মাণের সময় দর্শনায় ভৈরব নদের ওপর রেলসেতু নির্মাণ করা হয়। এই সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে মেহেরপুরের উজানে আপার ভৈরব বেঁধে দেওয়া হয়, যে কারণে ভৈরবের পানিপ্রবাহ কমে যেতে থাকে। এরপর ১৯৩৮ সালে দর্শনায় ভৈরব নদের বড় ধরনের বাঁক ভরাট করে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনিকল স্থাপন করা হয়। এর ফলে ভৈরবে মিঠাপানি কমে যেতে থাকে।

 আপার ভৈরব দ্রুত মরে বুড়ি ভৈরবে পরিণত হয়। সাগরের জোয়ার-ভাটায় কোনোরকমে টিকে থাকে লোয়ার ভৈরব। আপার ভৈরবে পানি না থাকায় মরণদশা হয় কপোতাক্ষের। সেই সঙ্গে কপোতাক্ষের শাখা-প্রশাখাগুলোর। এরপর গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বেশি ফসল উৎপাদনের জন্য সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে অসংখ্য বাঁধ-পোল্ডার-স্লুইস গেট নির্মাণ করে সাগরের লোনা পানি ঢোকানো হয়। এই প্রকল্পে ব্যাপক সুফল পাওয়া যায় দেড় যুগ পর্যন্ত। যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরার উপকূল এলাকায় ব্যাপক ফসল ফলে। কিন্তু এর পরই দেখা যায় এ প্রকল্পের ভয়াবহ রূপ। নদ-নদীগুলোর একমুখী স্রোত সমুদ্র থেকে বিপুল পলি এনে নদীগুলোর তলদেশ ভরাট করতে থাকে। দ্রুত মারাত্মক জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে পড়ে এ এলাকা। শত শত কোটি টাকা খরচ করেও এখন এ সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাচ্ছে না।

একসময় ভৈরব ও কপোতাক্ষের মধ্যবর্তী অঞ্চলের অতিরিক্ত পানি এ দুই নদের শাখা বেতনা, মুক্তেশ্বরী, হরিহর, শ্রীনদী, টেকা, ভদ্রা, বুড়িভদ্রা, সালতা, শোলমারি, তেলিগাতি, হামকুড়ো, ময়ূর নদীতে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু প্রধান দুই নদের অবস্থা মৃতপ্রায় হয়ে যাওয়ায় এ শাখা নদীগুলোর বেশির ভাগেরই আজ অস্তিত্ব নেই। ভৈরবের শাখা মুক্তেশ্বরী যশোর বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে পুলেরহাট, সতীঘাটা হয়ে মশিহাটিতে ভদ্রা নদীতে মিশত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুক্তেশ্বরী নদীর পাশে যশোর বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়। এ সময় মুক্তেশ্বরীর উজানের জলপ্রবাহ খাল কেটে কপোতাক্ষে প্রবাহিত করা হয়। উজানের পানি না পেয়ে মরে যায় মুক্তেশ্বরী। একসময়ের প্রমত্তা হরিহর নদী ঝিকরগাছার লাউজানী থেকে মনিরামপুর, কেশবপুর হয়ে ভদ্রায় মেশে। হরিহরের এক শাখা শ্রীনদী মনিরামপুরের বাজিতপুর, কাছারিবাড়ী ও কুমোরঘাটা হয়ে ফুলতলা উপজেলার ভিতর দিয়ে বিল ডাকাতিয়ায় পড়ত। ভৈরবের আরেক শাখা বোয়ালমারী থেকে নওয়াপাড়ার পূর্বপাশ দিয়ে চলিশিয়া হয়ে মিশত মুক্তেশ্বরীতে। পরে ভবদহের পূর্বদিকে মোড় নিয়ে সে শাখাটি জামিরার পশ্চিম পাশ দিয়ে বিল ডাকাতিয়ায় পড়ত। এরপর থুকড়ো, আমভিট হয়ে হামকুমড়ো নদীতে মিশত। ভৈরবের আরও একটি শাখা রাজঘাটা। এটি ভুলোপাতা বিল হয়ে ধোপাখোলার মিলিত স্রোত নিয়ে ফুলতলা, পয়গ্রাম-কসবা ও শিকিরহা থেকে বুড়োডাঙ্গি, দামোদর হয়ে নামত বিল ডাকাতিয়ার শোলমারিতে। পশ্চিমবাহী অন্য শাখাটি আমভিট, হামকুমড়ো হয়ে মিশত ভদ্রায়। জালের মতো বিস্তৃত এসব নদী প্রাকৃতিকভাবেই এ এলাকার অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করত। উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় মুক্তেশ্বরীকে শ্রীনদীর সঙ্গে যুক্ত করে ক্রসবাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর ফলে মরে যায় শ্রীনদীর সব শাখা। ১৯৯৫ সালে মরতে শুরু করে হামকুমড়ো নদী। কপোতাক্ষের দুই শাখা হরিহর ও ভদ্রা। ভদ্রা কেশবপুর, গৌরীঘোনা, ভরতভায়না, ডুমুরিয়া হয়ে শিবসা ও পশুর নদীতে মিলত। এই যাত্রাপথে ভদ্রার ছিল বেশকিছু শাখা-প্রশাখা। খর্নিয়া থেকে ভদ্রার এক শাখা তেলিগাতি নামে গ্যাংরাইল, হারিড়া নদী হয়ে শিবসায় পড়ত। এখন আর এগুলোর কোনো চিহ্ন নেই। বেদখল হয়ে গেছে এসব নদ-নদীর বেশির ভাগ জায়গা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর