সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

হেঁটে পাড়ি ব্রহ্মপুত্র-যমুনা

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

হেঁটে পাড়ি ব্রহ্মপুত্র-যমুনা

ব্রহ্মপুত্র নদের বুক চিরে পায়ে হেঁটে চলাচল করছে মানুষ

এক সময় লঞ্চের পাশাপাশি চলত সারি সারি নৌকা। লঞ্চের ভেঁপুর শব্দ আর মানুষের পদচারণায় দিনরাত মুখরিত ছিল গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র নদের বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাট। নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল জমজমাট। নাব্যতা সংকটের কারণে সেই প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার বুকে এখন কেবলই দিগন্তজোড়া ধু-ধু  বালুচর। সরু খালে পরিণত হয়েছে আরও ৫টি নদী। পানিপ্রবাহ শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাটসহ ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার ১০৫টি আন্তঃজেলা ও অভ্যন্তরীণ নৌ-রুট বন্ধ হয়ে গেছে। নদীতে নৌ-চলাচলের জন্য পানি কম ও ১০৫টি পয়েন্ট বন্ধ হওয়ায় চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনের তাগিদে হেঁটেই পার হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদ। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে নদ-নদীগুলো ড্রেজিং না করা এবং বিভিন্ন স্থানে এসব নদীর দুই পাড় দখল করে নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ, নদীগুলো থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করায় গাইবান্ধার নদ-নদীগুলো অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এসব এলাকার মাটি ধসে পড়ছে এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।

তবে আশার কথা, ব্রহ্মপুত্র নদে বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ১৮ মার্চ ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুট প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের উদ্বোধন করেন নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। ইতিমধ্যে নদী খননের জন্য ১০০টি ড্রেজার ক্রয় করা হয়েছে, যা দিয়ে গাইবান্ধার ১৭৮টি নৌপথ খনন করা হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ৭টি নদ-নদী। এগুলো হলো- ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, করতোয়া, আলাই, কাঁটাখালী ও ঘাঘট। চৈত্রের শুরু থেকে প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় পানিপ্রবাহ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এক সপ্তাহ পর পানিশূন্য হয়ে পড়বে বলে নদী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া ড্রেজিংয়ের অভাবে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দখলের কারণে তিস্তা, করতোয়া, আলাই, কাঁটাখালী ও ঘাঘট নদ শুকিয়ে গেছে। নাব্যতা সংকটের কারণে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার চরে বিভিন্ন ফসলের আবাদ হচ্ছে। বাজারঘাট, পড়ালেখাসহ প্রয়োজনীয় কাজ সারতে গাইবান্ধাসহ আশপাশের কয়েক জেলার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বন্ধ হয়েছে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে নৌ-চলাচল। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনাকে অবলম্বন করে যে সব পরিবার, মাঝি-মাল্লা, জেলে, চাষি জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল তারা এখন কর্মহীন হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। অনেকেই বাপ-দাদার আদি পেশা ছেড়ে খেত-খামারে কাজ করছেন। আবার অনেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে নানা পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।

 গাইবান্ধার প্রবীণ সাংবাদিক আবু জাফর সাবু জানান, সামান্য পানিতেই তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীতে লঞ্চ চলত। চলত সারি সারি নৌকা। সেগুলো এখন পানির অভাবে চলছে না। এক সপ্তাহ পরে পানিপ্রবাহ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। তখন ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও তিস্তার বুকে গরু-মহিষের গাড়ি চলবে।

 ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের ভাষারপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মোজাম্মেল হক বলেন, ছোটকালে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার যে প্রমত্তা রূপ দেখেছি, বৃদ্ধ বয়সে এসে নদ-নদী দুটির করুণদশা দেখছি। পরের প্রজন্মরা হয়তো জানবে এখানে দুটি নদী ছিল। উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ফুলছড়ি চরের বাসিন্দা একাব্বর আলী বলেন, বর্ষায় নৌকায় যাতায়াত করলেও এখন শুকনো মৌসুমে হেঁটে চলাচল করছি।  রিভাইন পিপলের পরিচালক ও নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নদ-নদীগুলো শুকিয়ে মৃতপ্রায়। অনেক নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। নদ-নদী রক্ষায় এখনই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে এক সময় কাগজে-কলমে নদীর নাম থাকবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ তখন নদীহীন হয়ে পড়বে। বালাসী রেলওয়ে ফেরিঘাটের মেরিন সুপারিনটেনডেন্ট মশিউর রহমান বলেন, নাব্যতা হারিয়ে যাওয়া এবং পানির ন্যায্য হিস্সা না পাওয়ায় ফেরি সার্ভিস চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে নদী খননের মাধ্যমে রেলওয়ে ফেরি সার্ভিস চালু হলে জনগণ একদিকে যেমন উপকৃত হবে অন্যদিকে সরকারের রাজস্বও বাড়বে। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল বলেন, এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো ড্রেজিং করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও সরকার জেলার আন্তঃ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের প্রয়োজনেই নদ-নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

সর্বশেষ খবর