মঙ্গলবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

খুনেই শেষ খুনির জীবন

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনেই শেষ খুনির জীবন

রক্ত ঝরছে। লাশ পড়ছে। একের পর এক। কারো চোখ বাঁধা। কারো আবার হাত। কখনো রেললাইনের ওপর। কখনো রেললাইনের পাশের বস্তি ঘরে। রাতে দিনে কোনো পার্থক্য নেই। যখন তখন মিলে লাশ। কিন্তু খুনি ধরা পড়ছে না। তেজগাঁও রেলস্টেশনের আশপাশ থেকে এভাবে লাশ উদ্ধারের পর আতঙ্ক চারদিকে। পুুলিশ ও গোয়েন্দাদের অপরাধীর তালিকার প্রথম নামটি নজরুলের। ছোটখাটো গড়নের দুর্ধর্ষ এই হিটম্যানকে কখনো পুলিশ পাকড়াও করতে পারে না। তার ভয়ে গোটা তেজগাঁও এলাকা রীতিমতো কাঁপত। তার সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস ছিল না ঢাকার অন্য কোনো অপরাধীর। বড় মাপের বহু অপরাধীও তার কাছে এসে ধোপে টিকেনি। তেজগাঁও রেলস্টেশন কেন্দ্রিক বৈধ-অবৈধ সব ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রক ছিল এই নজরুল। এলাকায় সে এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, পুলিশ তাকে ধরতে গেলে সেখানকার লোকজনই তাকে লুকিয়ে রাখত। রেলস্টেশন কলোনির প্রতিটি ঘরে ঘরে ছিল তার লোকজন।

তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, এই নজরুল খুন করত নিজস্ব নিয়মে। সাধারণত রোগীকে অপারেশন করার আগে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে প্রস্তুত করা হয়। পরে সার্জন এসে অপারেশন করে থাকেন। ঠিক সেভাবেই কাউকে খুন করাতে হলে ওই ব্যক্তিকে তার সহযোগীরা প্রস্তুত করে রাখে। নজরুল গিয়ে শুধু খুনের কাজটি করে চলে আসত। সহযোগীরা ওই ব্যক্তির হাত-পা চেপে ধরে রেলের পাতের ওপর শুইয়ে দিত। এরপরই শুরু হতো নজরুলের নিষ্ঠুরতা। হাত ও পা রেলের পাতের সঙ্গে পিষে যাওয়া পর্যন্ত হাতুড়িপেটা করেই যেত নজরুল। এক সময় হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া ব্যক্তির লাশ ফেলে রাখা হতো রেললাইনের পাশে কিংবা কোনো পরিত্যক্ত বগির ভিতর। আর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করত বেশি। তার নৃশংসতার কারণে শত্রুরাও তার ধারে কাছে ঘেঁষত না। রেললাইনের ওপর ফেলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে এমনভাবেই অসংখ্য খুন করেছে নজরুল। তার নৃশংসতায় অনেকেই এখন পঙ্গু। খুনের জন্য তিনি পিস্তল বা চাপাতি, রামদার চেয়ে হাতুড়ি পছন্দ করতেন। তার অধিকাংশ খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে হাতুড়ি দিয়ে। নিহতদের বেশিরভাগই ছিল তার প্রতিপক্ষ আর তেজগাঁও স্টেশন এলাকার অপরাধী। এই নজরুল ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছে গোটা তেজগাঁও এলাকায়। ছোটখাটো দেখতে এই দুর্ধর্ষ অপরাধীকে ভয় করত ঢাকার অন্য সন্ত্রাসীরাও। নজরুলের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। নজরুলের বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। রেল কলোনিতেই তারা থাকতেন। মানুষ খুনে তার নিজস্ব নিয়ম ছিল। ১৯৮৬ সালে তেজগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে নজরুলের স্কুলপড়ুয়া ছোটভাইয়ের সঙ্গে কলোনির মাসুদের মারামারি হয়। একপর্যায়ে একজন আরেকজনকে ছোরা বসিয়ে দেয়। এ ঘটনার জের ধরে কলোনির লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা তখন নিত্যদিনকার ঘটনা। স্থানীয়দের উদ্যোগে সেখানে দুই পক্ষের সমঝোতা বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। এক সন্ধ্যায় বসে সে বৈঠক। কিন্তু বৈঠক চলাকালে স্টেশন এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাতের আঁধারে বৈঠকেই হামলা চালানো হয়। কুপিয়ে নৃশংসভাবে সেখানে খুন হয় মাসুদের বাবা ও ফুফাতো ভাই। এই জোড়া খুনটি পরিকল্পিতভাবেই তখন করা হয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। এই জোড়া খুনের পর থেকেই নজরুল আরও দুর্ধর্ষ হয়ে পড়ে। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, ভাড়াটে হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও তিনি গুণ্ডামি করেছেন। অস্ত্র চালিয়েছেন। ওই এলাকায় তার ওপর তখন আর কেউ ছিলেন না। অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েন নজরুল। কিন্তু অসংখ্য খুনের এই খুনির জীবনও শেষ হয় খুনের মধ্য দিয়েই। তার খুনের পর অনেকেই হতবাক হয়েছিল। কারণ সে সময়ে তার সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস কারও ছিল না। ১৯৮৯ সালের এক রাতে তার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় বসে। বন্ধুরা তাকে মদের নেশায় মাতাল বানিয়ে দেয়। মদের আসরে বন্ধুদের মধ্যেই যে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সন্ত্রাসীরাও ছিল তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি নজরুল। রেলওয়ে কলোনিতেই নজরুলের বাসার সামনেই এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। একদিন আগেও যার প্রভাবে রেলস্টেশন এলাকা কাঁপত, মুখ তুলে কথা বলার সাহস ছিল না, সেই নজরুলের লাশ পড়ে থাকে রাস্তার ধারে। শুধু তাই নয়, তার লোকজন ওই রাতেই এলাকা ছেড়ে পালাতে থাকে। সেখানেই শেষ হয় নজরুলের শাসন। নজরুলের মৃত্যুর পেছনে ছিল সেখানকার চোরা খালেক। পরে তার মৃত্যুও হয় অন্যজনের হাতে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুনি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তার পরিণতিও একই ধরনের হয়। খুনেই খুনির জীবনের অবসান ঘটে। তার প্রমাণ প্রতিটি অপরাধীর মৃত্যুতেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর