মঙ্গলবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-১৮

বুড়িগঙ্গার তীরে একমাত্র নীলকুঠি

মাহবুব মমতাজী

বুড়িগঙ্গার তীরে একমাত্র নীলকুঠি

নদীতে ভাসছে একটি স্টিমার। আছে কিছু ছোট নৌকা। ঘাটে অপেক্ষারত কিছু লোক। এটি ১৯১৭ সালের বুড়িগঙ্গা তীরের ওয়াইজঘাটের একটি ছবির বর্ণনা। বুড়িগঙ্গা তীরের নীলকর জেপি ওয়াইজের বাসভবনের সামনের সিঁড়িযুক্ত ঘাটটিই ওয়াইজঘাট। গোটা ঢাকার মধ্যে নীলকরদের নীলকুঠিগুলোর মধ্যে টিকে আছে শুধু এটিই। যাকে নীলকুঠিও বলা হয়ে থাকে। নীলকুঠি বললেও দেখতে হলদে রঙের। নীলকুঠিতে এখন বুলবুল ললিতকলা একাডেমি। এ জায়গাটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে তোড়জোড় চালিয়েছে বিভিন্ন জালিয়াত চক্র। সাধারণদের কাছে বাড়িটি অজানা থাকলেও পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের মধ্যে তুলনামূলক অক্ষত আছে তা। উনিশ শতকে অবশ্য ঢাকা শহরে তিনজন ওয়াইজ পরিচিত ছিলেন। একজন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, একজন সিভিল সার্জন এবং একজন নীলকর। পূর্ববঙ্গে নীলকর ওয়াইজের বিস্তৃত জমিদারি ছিল। সাধারণ বাঙালিদের ওপর তাদের অসহনীয় নিপীড়নের দুঃসহ কাহিনী প্রায় সবার জানা। একটু ইতিহাস জেনে আসা যাক, ১৭৭৭ সালে বাংলায় তথা ঢাকায় প্রথম নীল চাষ শুরু হয়। ঢাকার নীলক্ষেত এলাকার বিরাট প্রান্তরজুড়ে নীল চাষ করা হতো। আজও নীলক্ষেতের নামের সঙ্গে নীল শব্দটি জড়িয়ে আছে। ১৮৩০ সালে সরকারিভাবে আইন জারি করে বাংলার তথা ঢাকার কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করা হয়। এতে নীলকররা আরও শক্তিশালী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নীল চাষ করতে না চাইলে কৃষকদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হতো। ১৮৪৭ সালের দিকে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল। সবচেয়ে নামকরা নীলকর ছিলেন জে পি ওয়াইজ। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনে নীলকর ওয়াইজের প্রভাব ছিল ব্যাপক। সবাই তাকে একনামে চিনত। নীল চাষের মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে ধনাঢ্য বণিকে পরিণত হন ওয়াইজ। তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো শক্তি ও সাহস তখন কারও ছিল না। তার প্রভাব এত বেশি ছিল যে, সাধারণ জনগণ তাকেই সরকার বাহাদুর মনে করত। এই ওয়াইজের পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময় ঢাকা নিউজ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করা হতো। পত্রিকাটি ইংরেজ সরকারের মুখপত্র হিসেবে কাজ করত। ওয়াইজের বাড়ির পাশে নদীর ঘাটে বড় নৌকা ও বজরা বাঁধা থাকত বলে একসময় এই ঘাট ওয়াইজঘাট নামে পরিচিতি পায়। ১৮৫১ সালে নীলকর ওয়াইজ ভাওয়াল রাজা কালী নারায়ণের কাছে তার জমিদারি বিক্রি করে ইংল্যান্ডে চলে যান। তবে তার বাড়ির পাশের ঘাটটি এখনো ওয়াইজঘাট নামেই রয়ে গেছে। ওয়াইজঘাট এখন বুড়িগঙ্গার ব্যস্ততম একটি ঘাট। সরেজমিন দেখা যায়, ওয়াইজ হাউস অর্থাৎ নীলকুঠির নিচতলা ও দোতলায় চলে বুলবুল ললিতকলা একাডেমির নাচ আর গানের ক্লাস। বাড়িটির মূল ভবনের উত্তর-পশ্চিম কোণের ঘরটি অফিস রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাশেরটি দোতলায় ওঠা সিঁড়ি ঘর। কারুকার্যখচিত পেঁচানো সিঁড়িটি আজও নজর কাড়ে। সেখানে আভিজাত্য-শৌখিনতার অন্যন্য ছাপ। প্রতিটি ঘরই বেশ প্রশস্ত। যেন ঘরগুলো প্রাকৃতিক উপায়ে তাপানুকূল কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ভবনের দুই পাশে ফাঁকা জায়গা। উত্তর অংশটি একরকম খেলার মাঠের মতো। বাড়ির চারপাশে দেয়ালে ঘেরা। দেয়াল থেকে তিন ফুট দূরত্বে রয়েছে প্রায় অর্ধশত বছরের কয়েকটি আম-কাঁঠালের গাছ। পশ্চিমে দেয়াল ঘেঁষে আছে কিছু ছোট ঘর। বলা হয়- সেগুলো বাড়ির কর্মচারীদের আবাস। এর একটি ঘর এখন দক্ষিণ সিটির ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জানা যায়, সেই ৫০ দশকে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক নীলকুঠির ১.২১ একরের এই জায়গা ইজারা নিয়ে গড়ে তোলা বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা)। তার আগে কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে ঢাকার নওয়াব এস্টেটের কাছ থেকে তারা জমিটি একসনা ইজারা নেয়। এরপর থেকে সংগীত শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিপুল অবদান রেখে চলেছে। নীলকুঠি তথা বাফার ওই সম্পত্তির বর্তমান বাজারমূল্য এখন ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু একাধিক জালিয়াত চক্র এই সম্পত্তি দখলের জন্য বার বার থাবা দিয়েছে। একটি জালিয়াত চক্র নীলকুঠির ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করেনি। ব্যাংক সুদ-আসলের টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছিল। আদালত সমুদয় সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে পাওনা টাকা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিল। এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কিন্তু বাফা রিট করলে উচ্চ আদালত সেই নিলাম কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ দেয়। বিগত দিনেও বাফার সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আমানউল্লাহ চৌধুরীর নামে একজন জাল দলিলের মাধ্যমে নীলকুঠিটি কেনার নাম করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা চালান। মূলত বাফার টাকা আত্মসাতের জন্যই তিনি যোগসাজশ করে নীলকুঠির জমি কেনার চেষ্টা করেছিলেন। এ নিয়ে তখন আদালতে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলাও হয়। বাফার শিক্ষকরা বলছেন, তাদের উত্খাত করে জমি দখলের উদ্দেশেই নানা জালিয়াতি-ষড়যন্ত্র চলছে।

সর্বশেষ খবর