বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

অবৈধ স্থাপনা তিতাসে

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। অথচ অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে নদী। নদী বাঁচাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ২০তম পর্ব আজ।

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

অবৈধ স্থাপনা তিতাসে

‘তুই যদি আমার হইতি, আমি হইতাম তর, তরে লইয়া ঘর বানামু গহিন বালুর চর...’। তিতাসের বুকে পালতোলা নৌকার মাঝিদের এমন ভাটিয়ালি গান আর শোনা যায় না। সবকিছু হারিয়ে যৌবনা তিতাস কঙ্কালসার! রূপসী তিতাসের বিবর্ণ রূপ দেখে অদ্বৈত মল্ল বর্মণের তিতাসের সঙ্গে তুলনা করলে শুধুই কল্পিত বলে মনে হয়। এক সময় ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙত, দিনের সূর্য তাকে তেতিয়ে উঠাত, রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইত, কিন্তু এখন তা পারে না। কালজয়ী ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্ল বর্মণ তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস লিখে তিতাসকে পরিচয় করে দিয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে। তিতাসের নামেই দেশের অন্যতম গ্যাসকূপ ‘তিতাস গ্যাস’। তিতাসের সেই জৌলুস আর নেই। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় আগের মতো জেলেদের মাছ ধরতেও দেখা যায় না। স্রোতস্বিনী তিতাসের বুকে জেগে উঠেছে চর।

সূত্র মতে, মেঘনা থেকে বোমালিয়া খাল দিয়ে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-নাসিরনগর ব্রিজের নিচ দিয়ে ভাটির দিকে যে পানি প্রবাহিত হচ্ছে তা থেকে তিতাস নদীর সৃষ্টি। পরে তা জেলার নবীনগর উপজেলার চিত্রি গ্রামে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিলেছে। দেশের অন্যান্য নদীর চেয়ে বেশি আঁকাবাঁকা। সর্পিল তিতাসের প্রায় ৪০ কিলোমিটার ভরে গেছে। নদীর বুকে এখন আর মাঝি-মাল্লাকে পালতোলা নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায় না। বর্ষায়ও চোখে পড়ে না তিতাসের রুদ্র মূর্তি। পাড় দখল করে গড়ে ওঠেছে অবৈধ স্থাপনা। কোথাও কোথাও চোখে পড়ে জেগে ওঠা চর। বর্ষা মৌসুম শেষের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন নৌ-রুট। শুকনো স্থানে পড়ে থাকা নৌকাগুলো দেখে মনে দাগ লাগে। আখাউড়ার দিকে ধাবিত তিতাস সম্পূর্ণ মরে গেছে।

এক সময়কার কালীদাস সায়র (সাগর) নামে পরিচিত তিতাস নদী ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে কল্পনাও করা যেত না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, সদর, বিজয়নগর, নাসিরনগর ও নবীনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তিতাসের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বড় বড় হাট-বাজার। ব্যবসায়ীরা পণ্যসামগ্রী নৌকা দিয়েই আনানেয়া করত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার আনন্দবাজার, টানবাজার, গোকর্ণঘাট, বিজয়নগরের চান্দুরা বাজার, নাসিরনগরের হরিপুর, সরাইলের শাহবাজপুর, আখাউড়ার বড়বাজার ও নবীনগরের বড়াইল, গোসাইপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে বড় বড় বাজার। ঘাটগুলোতে ভিড় করত মালবাহী বড় বড় নৌকা। নদীকে ঘিরে আখাউড়া বড়বাজার, বিজয়নগরের চান্দুরা, নাসিরনগরের হরিপুরে গড়ে উঠেছিল বিশাল পাটের বাজার। ছিল বিরাট আকৃতির গুদাম। নদী ভরাটে জেলেদের ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। কমপক্ষে অর্ধ লাখ জেলে এক সময় নৌকা ও ডিঙ্গি দিয়ে সারা বছরই মাছ ধরত। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ছিল মাছ ধরা। এখন অধিকাংশ জেলে পরিবারেই পেশা পরিবর্তন হয়েছে। খনন না করায় স্রোতস্বিনী তিতাস নাব্যতা হারিয়েছে। অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ি ঢলে নদী ভরাট হচ্ছে। ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা পলি তিতাসের নাব্যতাকে থামিয়ে দিচ্ছে। দখলবাজদের কবলে পড়ে স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শাহবাজপুর, মজলিশপুর, বাকাইল, শহরের পূর্বমেড্ডা, পাইকপাড়া, আনন্দবাজার, টানবাজার ও শিমরাইলকান্দি এলাকায় পাড় ভরাট করে গড়ে উঠেছে স্থায়ী অবৈধ স্থাপনা। নাব্যতা হারানোর ফলে কৃষি জমিতে সেচকার্যে বিঘ্ন ঘটছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহীনুজ্জামান জানান, তিতাসের ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৯১ কিলোমিটার নদী খননের জন্য ১৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অত্যাধুনিক ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাগলা এবং তিতাসের ১৯.১২৩ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে। আশা করি ২০২০ সালের জুনের মধ্যে এর খনন কাজ সম্পন্ন হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর